মোহ পর্ব ১১





মোহ(কবিতা)

|ভূমিকা
কবিতা সাহিত্যে ক্ষুদ্র অথচ শ্রেষ্ঠ অলংকরণ। অর্থের বিশালতা ,বাক্যের নিপুনতা আর ভাবের গভীরতায় এর বুননসাহিত্য-সংস্কৃতির প্রানভোমরাযা কর্ম প্রেরনার অনুপম বিকাশ, উদ্দেশ্যমুখী জীবনচিন্তার মসৃণ গতিপথ
আলেয়ার পথে হাঁটা বেদুইনের মত পাঠকও যদি প্রবেশ করে সেও আর ডানা ভাঙা বাদুড়ের পথ অনুসরন করবে না । ভোরের বাতাসে পাখির শিস হয়ে কবিতা তার কানে দোলা দেবে। 
যৌক্তিক আবেগ-অনুভূতি ও একনিষ্ঠা মনভাব নিয়ে কবিতা কাননে প্রবেশ করলে  ফুলের গন্ধ আর কবিতার ছন্দ এক হয়ে যাবে। কবিতাগুলো ফুল হয়ে ছুঁয়ে যাবে সমস্ত শরীর। কবিতার মাথায় চাপা বোঝাগুলো কেমন যেন কর্পূর হয়ে উবে যাবে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে পড়বে সমস্ত দগ্ধ শরীরে পাপড়ি বেয়ে বেয়ে

   - ‘চলো কবিতা কাননে প্রবেশ করি’
                                      -সেলিম উদ্দিন মণ্ডল|
|
প্রথম দশক – কবিতার ‘এই সময়’...  -  রাজর্ষি মজুমদার

.
প্রতিটা দিনই মনে হয় নতুন কতো কি হতে পারত অথচ হলোনা তেমন কিছুই এসব অনন্ত সম্ভাবনা ছেড়ে ছোটোবেলার দিকে তাকালে দেখি, কীরকম সব - ঘুম ঘুম , মায়া মায়া সময় কেটেছে বড় হবার সাথে সাথে দুকুপুকানি কমে খাতায় কথা বলার অদ্ভুত অভ্যেস বাড়তে থাকে মনে হয়, এরকম একটা জীবন পেয়েছি যেখানে আমার বাঁচাটুকু কবিতায়, নিজের স্বরূপ প্রতিদিন যেন অন্য অন্য ভাবে আবিষ্কার করে ফেলছি আজকাল
শুধু চেতনগ্রাহ্য বা অতীন্দ্রিয় ভালোলাগা নয়। আমরা, অন্তত আমি এক ফর্ম্যাটের মধ্যে আনতে চেয়েছি দৈনন্দিনকে। এই প্রতিদিনের খাওয়াপরাটুকু আমাদের কবিতাকে পৃক্ত করছে ধীরে ধীরে।
একান্তে, পরিসর তৈরি হচ্ছে এভাবেই


.
আমরা যখন লিখতে আসছি, ঠিক তার আগেই শূন্য দশক সমস্ত ট্যাবু ভেঙে দিয়েছে একটা প্রায় নেই হওয়া জায়গায় আমরা বরাদ্দ হলাম হ্যাঁ ততদিনে অন্তত এইটুকু জেনে গেছি যে কি লিখবনা কি লিখব সেটার খোঁজ শুরু হল ভেতরে ভেতরে
নব্বই এর কবিতায় গোণাগুনতি কয়েকজন বাদ দিলে টানটা সেই পুরোনোর দিকেই - সেখানে শূন্যের স্টেটমেন্ট একেবারে স্বতন্ত্র। মূলত আধুনিক জীবনের তাল কাটার অন্যরকম কথা যা সাবজেক্টিভে লেখার বাইরের কিছু, ক্রাইসিসটাকে জাস্টিফাই করা। এই সময়েই কবিতার সাথে অন্য শিল্পকে আনবার একান্ত প্রয়াস দেখা দিলো। মাঝের দশকে শব্দ, ফর্ম , কন্টেন্ট, ছন্দ ইত্যাদির জাগলারিতে যা হারাতে বসেছিলো। আসলে শূন্যের শেষদিকে ফেসবুকের প্রবেশ এই দশকের কবিতা চর্চাকে এক বিরাট রকম বুস্ট দিয়েছিল
আমার একটা লাইন লেখার আগেই যে বাংলা কবিতায় শূন্যের মতন একেবারে যুগন্ধর দশক কেটে গেছে এটা জানতে বুঝতেই আমার বেশ কিছুদিন চলে গেছল
অর্জুন দা, জুবিন দা এই দুজনের সাথে বিভিন্ন ইন্টার‍্যাকশন বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করছিল পূর্ববর্তী দশকের স্থায়ী একটা চিত্র পেতে - যা আমাকে পরবর্তীতে জানাবে যে আমার লেখাটা ঠিক কোন জায়গাটাকে ইন্ডিকেট করবে, বা আমাকে করাতে হবে


.
নিজের লেখাটার খোঁজ যখন চলছে, অনুভব করলাম একটা পরিবেশ দরকার। সমমনষ্কদের একটা পরিমন্ডল। যেখানে অনেকের সাথে আমার প্রবলেমগুলো শর্ট আউট করতে পারব। আবার যারা এই স্টেজগুলো পেরিয়ে গেছে তারা তাদের প্রতিক্রিয়াগুলো নির্দ্বিধায় এক্সপ্রেস করবে এক্সপিরিয়েনস এর জায়গা থেকে
কিছু ক্ষেত্রে আমাদের খিদেটা সঠিক ভাবে চ্যানেলাইজ হবে। অন্তঃত প্রথম দিকে আমরা সবাই অবচেতনে কম বেশী চ্যানেলাইজ হতে চেয়েছি। নিজস্বতার দিকে, এক রকম পা বাড়ানো। যার ফল প্রায় বছরখানেক বাদে আমাদের কাছে আজ স্পষ্ট হয়ে এসেছে।
আমাদের তথাকথিত কফি হাউস ছিলনা প্রতিদিনের জন্যে। একটা পড়ে পাওয়া ফেসবুক পরিসরে আমরা গুল খিলিয়ে তুলতে শুরু করেছিলাম। সমমনষ্কদের ঠেক হয়ে উঠেছিল ক্ষেপচুরিয়াস। সম্ভবত আমাদের দশকের কবিতাই সর্বপ্রথম একটা ভার্চুয়াল জগতে বেড়ে উঠলো




.
সময় অনেককে গুছিয়েছে - সেই ফাঁকে উত্তরাধিকার চলে এসেছে কলমে, অজান্তেই দোষারোপ করার জন্যে এখনও কাউকে পাওয়া যাচ্ছেনা
জীবনানন্দ অনুমান করেছিলেন ভবিষ্যতের কবিতা হবে দীর্ঘ শ্লেষ যুক্ত। ২০০৩ ভাস্কর লিখলেন যে শ্লেষ বাংলা কবিতায় সুন্দর ভাবে এলেও কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা ছাড়া তার আর বিশেষ কিছু মনে ধরেনি। প্রায় এক দশক পরে প্রথম দশকের শুরুর দিকে এই দুটো ব্যাপারের একসাথে একটা প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি দুজন কবির লেখায় ঋষি সৌরক আর অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী। উদাহরণে গেলে স্পষ্ট হবে ব্যাপারটা
ঋক দা ওর দীর্ঘ কবিতা 'চু' তে লিখছে -
" প্রতিটি বমিই লেগে গেছে অন্ধকার থেকে উঠে আসাদের গোঁড়ালিতে
বিধাতা কথা এখানে প্রাসঙ্গিক নয় মোটেও
তিনি বমি করেন না পাদেন না সাম্যবাদের তাগিদও অনুভব করেন না
তিনি সব সিনেমার হিরো
যদিও পানুসিনেমায় হিরো আমাদের অতিপরিচিত
ব্ল্যাক-আউটএক এবং একমাত্র অদ্বিতীয়ম্ব্ল্যাক-আউট …"

আবার অতীন এর ' সলমন খান সেলামেষু ' কবিতার কিছু লাইন এরকম -
" অতএব প্রকাণ্ড ভালোবাসা মহাদানব হয়,
মোহরাগ ছুটিয়েছে দখিনা বাতাস
লুটিয়েছে অজস্র নটে ভেবে চন্দ্রমল্লিকা,
জাগিয়েছে, ধিকিধিকি, শেষরাত শুক্র, অন্ধ আদিম দেবতার তৃতীয় ভাটাচোখ,
খামচে নিংড়ে নিয়ে মরমী সুর্যাস্ত, নখরে,
শ্বদন্তে সনাতন স্পৃহা,
গোধূলিও সেইমত থমথম, রক্তবৃষ্টি হবে,
ভাঙবে রামধনু ব্রীজ হিংস্র, তীব্র তার অভিমান,
অনাদরি, চণ্ড কুঠারে কুপিয়ে জীবন মৃত্যুর অনাদি বনস্পতি - তফাৎ যাও, সব ঝুঠ হ্যায়।… "

আচ্ছা, কবিতার নামগুলো দেখেছেন? সলমন খান সেলামেষু আর চু কি মনে হল ? লেখালিখির তথাকথিত এস্টাবলিশমেন্ট এর গালে একটা থাপ্পড়। হাংরি আন্দোলন এর পরে সত্তর আশির দশক পেরিয়ে নব্বইতে যেটা হারাতে বসেছিলো। এই নতুন শতাব্দীর ভোগবাদী সংস্কৃতিতে লালিত হয়েও এরকম ধাক্কা খুব কম লেখকই দিতে পেরেছেন। তারপর অতীনের পংক্তি গুলোর দিকে নজর দিলে আমার বিশেষ ভাবে চোখে পড়ছে ওর দীর্ঘ বাক্য বিন্যাস আর শব্দচয়ন, যেটা সামহাউ শক্তির 'অনন্ত নক্ষত্রবিথী তুমি অন্ধকারে' মনে করাচ্ছে আমায়।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? প্রথম দশক কিন্তু বাংলা কবিতার চিরাচরিত ধারার বাইরে নয়। বরং এইসব টুকরো টুকরো কোলাজ মিলেই তৈরি হচ্ছে এক অননুকরণীয় স্টা

.
একটা সন্ধ্যে রিপিট হচ্ছে মাথায় - কদিন আগের চার দিকের হৈহৈয়ের মধ্যে, আলোর রোশনাইয়ে শুধুই সপ্তমী পূজা বেজে যাচ্ছে আমরা গল্প করছিলাম, আমি আর সুপ্রিয় সেই চিরন্তন গল্প যেগুলো একান্ত ভাবেই কবিতার ঘোর বাড়িয়ে তোলার জন্যে আমি গীটার শুনতে চাইলাম ভূপালি শোনাবে বললো তার টিউন করার সময়টুকু আমি চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবছিলাম এই সন্ধ্যে কীভাবে যেন আমার কবিতায় চলে এলোআমি লিখলাম -
" তার টিউন করার মাঝে
শরীর ঢুকে গেলো
আমাদের কার্তিক ছেয়ে যাচ্ছে শামিয়ানায় "
যাপন খুব প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত করছে এখনের কবিতা , এটা কখনই অস্বীকার করা যাবেনা।

কিন্তু শুধুই কি তাই? এর পরের লাইন গুলোয় আবার লিখেছি -
"দিল--জান থেকে
মরু বিহাগে
এলো এলো পায়েল বাজে যেন।"
আচ্ছা এই রাগ রাগিণীর নামের এই প্রয়োগ আমি কথা থেকে পেলাম? নিজেকে প্রশ্ন করলে উত্তর পাচ্ছি রঞ্জন দার কবিতায়। মাস তিনেক আগে ওর কবিতায় 'গৌড়সারং' শব্দের দারুণ একটা প্রয়োগ দেখে ছিলাম। সেটাই হয়ত অবচেতন নিয়ে এসেছে কবিতায়। কিন্তু আমি ব্যবহার করেছি অন্য একটা রাগ। আবার সেদিন সন্ধ্যেতেও রাগসংগীতই শুনেছিলাম, কথাও বলেছিলাম অনেক এই বিষয়ে। আসলে যাপনে মিশছে উত্তরাধিকার। আমাদের পরিণত হতে আরো সময় লাগবে। কিন্তু সেই পরিণতির দিকেই এখন প্রথম দশকের কবিতা, বাংলা কবিতাই যাত্রাপথ ঠিক করে দিচ্ছে

.
ভাস্কর চক্রবর্তী হ্যাঁ ভাস্কর চক্রবর্তী ষাটের দশকের এই কবির এক অদ্ভুত প্রভাব আগেই ছিলো পূর্ববর্তী কিছু কবির কবিতায়, মূলত তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মাঝখানে কিন্তু প্রথম দশকে যেন ভাস্কর পুনরাবিষ্কৃত হলেন তার কবিতা , কবিতা ভাবনা এতোটাই মোহোময় যে সেই আকর্ষণ উপেক্ষা করা প্রায় অসম্ভব হ্যাঁ এই দশকে এসে বলা যায় যে ভাস্কর কালজয়ী, নাহলে এত বছর পরেও তরুণদের মননে আর কলমে এক সাথে স্থায়ী যায়গা করে নেওয়া সহজ কোনো ব্যাপার নয় আজকালের কবিতা ওয়েব নির্ভর হয়ে ওঠায় সবার অবচেতনে কবিতা লেখার আগেই ধারণা তৈরি হচ্ছে মানুষ লেখাটাকে কীভাবে নেবেন? সবাই রিলেট করতে পারবেন তো? তাই বোধ হয় এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে কি এই সময় এর রিভিজিট ভালো? বিশেষত যখন মাইকেল , রবি ঠাকুর , জীবনানন্দের মত মাপের কবিদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসেছে এই বাংলা কবিতা সেখানে আগামীর কবিতা নতুন কিছু হবে সেটাই আকাঙ্খিত এই মুহূর্তে প্রথম দশকের স্বকীয়তার ক্ষেত্রে এটা সব থেকে বড় প্রশ্ন
৭.
প্রথম দশকে সবথেকে বেশী যেটা চোখে পড়ছে, তা হল পূর্ববর্তী সময়ের কবিতা আন্দোলন বা বিভিন্ন ধারার টুলস্ গুলোকে নিজেদের মত করে ব্যবহার। আর সেই প্রসেসটা কয়েকজনের ক্ষেত্রে এতটাই ব্যক্তিগত যে আলাদা করে আইডেন্টিফাই করা সম্ভব নয়। কিন্তু অনেকের লেখায় আবার সেটাই দৃষ্টিকটূ ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
অনেকেই ভাবতে ভুলে গেছে যে তেল মারা, দলাদলি, সংগঠন, আন্দোলন, প্রাতিষ্ঠানিকতা মায় প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা এ সমস্ত কিছুর বাইরে নিজের কবিতাটা লিখতে হবে। শূন্য দশক যেটা স্ট্রিক্টলি বর্জন করেছিল, তথাকথিত সাকসেস এর ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রথম দশকের কিছু কবি সেটাই গ্রহণ করেছে। এর জন্যে কিছুটা হলেও ওয়েব মাধ্যম দায়ী। এই প্রবণতা কিন্তু বাংলা কবিতার পক্ষে বিপজ্জনক।
তবে এই দশকে যারা লিখছি তারা প্রকরণ টা আয়ত্ত করতে পারলেও কবিতায় বোধ এর জায়গা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। আর তাছাড়াও এই দশকের কবিতার দানা বাঁধা সবে শুরু হয়েছে। পূর্ণতার দিকে এগোবার সাথে সাথে আমরা এসব ভুল শুধরে নেব আশা করি।
শুধু এটুকু বলেই শেষ করব যে আগামীর কয়েক বছর সবার চোখ থাকবে প্রথম দশকের কবিতায়। আশা করা যায় প্রথম দশক সেই আগ্রহের প্রতি জাস্টিস দেখাবে। |





|বরফবন্দীর ডায়েরি ও রঙিন নুড়ির রাজা - কবিতা মিশে যেতে যেতে
-তন্ময় ভট্টাচার্য্য

আষিক দা'র লেখা। 'বরফবন্দীর ডায়েরি' থেকে। কবিতার শেষ লাইনটা পড়ে চমকে উঠেছি। নিজে লিখতে পারলে, আর কিছু চাইতাম না....

"সেটুকুই ব্যক্তিগত, যেটুকু আঁধার হতে পারে

সকল ভাসিয়ে দেওয়া আলো
আত্মীয়, পরিজন, স্বর্ণকারের ঘরে তিলে তিলে জমে ওঠা
উপলক্ষ্য, সোনা

এই যে অদ্ভুত এক মায়াময় জমকালো
চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে অরক্ষণীয়ার অন্ধকারে

বিয়ে ভাঙবে না। কেবল ভাঙতে পারে বিয়ের ধারণা"

.
ধরে নিন, সারাদিনের জার্নি। ব্যাগে সিগারেটের প্যাকেট, জলের বোতল, বিস্কুট আর ট্রেনের টিকিট নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন। সঙ্গে থাকুক 'বরফবন্দীর ডায়েরি'ট্রেন আসছে না - এমন একটা দীর্ঘ অপেক্ষার সময়ে স্টেশনের কোনো চুপচাপ আলোর নীচে পড়া শুরু করলেন। "পরবর্তী অঘটন চিঠির দূরত্বে পড়ে আছে।" চমকে যাবেন না। কারণ পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আপনার চোখে পড়বেই -

"আমাদের মফঃস্বল
আমাদের ভিতরে থেকে যায়

আর একটু একটু করে
মফঃস্বলে
আমরা প্রবাস নিয়ে আসি..."

অথবা,

"দুটি ভিন্ন মতামত
প্রতিপক্ষ, লোকবল দিয়ে
উপস্থিত হয়েছে শেষ দ্বিধান্বিত মানুষটির কাছে

যাকে তোমরা ঈশ্বর ভেবেছ"

মনে পড়ে গেল অসামান্য একটি অণুগল্পের কথা। লেখকের নাম ভুলে গেছি। মনে আছে শুধু গল্পটি -
"The last man on earth sat in a room. There was a knock in the door".

আষিকদা'র কবিতার ওই শেষ দ্বিধান্বিত মানুষটি যেন অতর্কিতের কাছ থেকে ওই 'নক'টি বয়ে আনবে বলেই আঁকা হয়েছে।

----------------------------------

আর, ট্রেন থেকে নেমে একা একা বসে আছেন নদীয়ার কোনো ধানক্ষেতের ধারে। বিকেলের রোদ আপনাকে কী বলতে চায় বুঝি-বুঝি করেও বুঝতে পারছেন না। ব্যাগ থেকে বের করুন 'রঙিন নুড়ির রাজা' বইটি। মনে মনে একবার পড়ুন -

"...দেখব ঘুমন্ত ঝাউবন, বাবার সৈকতে এসে
চুপ করে ছুঁয়ে থাকে জলে ভেজা মায়ের আঙুল..."

অথবা,

"...তুমি গেয়েছিলে দুয়ার-ভাঙানো ঝড়
ধুলোর ঝাপটে অন্ধ আকাশ, চোখ
খুশিমনে তাকে ভিক্ষা দিয়েছে মা -

আমাদের বাবা তোমার প্রেমিক হোক!"

আর,

"...ভেতরটা বেআব্রু হয়ে চোখে পড়ে অসহায় গোল কুয়ো
আর সরু লিকলিকে পেয়ারাগাছ -
গাছটা হেলে পড়েছে জলের ওপর,
পাতারা ছুঁয়ে বলছে, এবার যাই

প্রাণপণে ঢেউ বুকে ধরে, জল বলছে - যাই বলতে নেই..."

.
তারপর, আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকা। ওই যে সন্ধ্যা নেমে আসছে ক্রমশ লাল হয়ে, ওখানে ঈশ্বরের মুখ ভেসে ওঠে। ধানক্ষেতের নির্জনতায় যার নাম শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়...|





|মেগাস্থিনিসের খাতা- A journey with Jubin Ghosh
-জয়তী অধিকারী

মেগাস্থিনিস...নামটা শুনলেই মনে পড়ে বহু শতাব্দীপ্রাচীন এক ভূগোলবিদের কথা, যিনি একজন পর্যটকও বটে। তাই মেগাস্থিনিসের খাতাশুনলে তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়াটা হয়, তা হল...সেই রাজদূতের দিনলিপি। সোজা কথায় যাকে আমরা ডায়েরী লেখা বলি। সেই কৌতূহল থেকেই হাতে তুলে নেওয়া জুবিন ঘোষের লেখা এই বইটি। পরতে পরতে যার বিস্ময় আর ভালোলাগা। আক্ষরিক অর্থে দিনলিপি না হলেও প্রতিটি লেখায় ছড়িয়ে আছে প্রেম, ভালোবাসা আর বিভিন্ন অনুভূতির সংমিশ্রণ।
দেবলীনাবা লীএমন একজন যে যেকোন তরুণের স্বপ্ন জুড়ে দিবারাত্রি অবস্থান করতেই পারে। যে  আপনার আমার মতই হাঁফিয়ে ওঠে শহুরে প্রাচুর্যে। তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে শহর আমার নয়, আমার অজ্ঞাতবাস সত্যিই আধুনিকতার অসংযমে দম আটকে আসা পরস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বোধহয় আবার সেই প্রাচীন সভ্যতাই আমাদের সকলেরই কাম্য।
কবি জুবিনের গান স্যালুটেপড়ে ভীষণভাবে মনে হচ্ছিল... কাশ্, অ্যায়সেহি কোই মুঝে ভি... কয়েক লাইন উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।
ভাবছি একদিন তোমাকে ঠিক চুমু খাব
                                  গান স্যালুটে
ভাবছি একদিন তোমাকে ঠিক চুমু খাব সেন্সর বোর্ডের সামনে
তোমাকে চুমু খাব রগরগে মার্কা
চুমু খাব টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স হলিউডি মুভির দৃশ্যে
ভালোবাসা, তুমি কি ঠোঁটে ঠোঁট পেতে দাঁড়াবে না!

উফ্ফ্, এক মূহুর্তে নিজেকে লীভাবতে ইচ্ছে করছিল! আমার প্রেমিকও যেন আমাকে এভাবেই বলে...
কোন অন্ধকারে নয়
ভাবছি একদিন তোমাকে ঠিক চুমু খাব সার্ক সম্মেলনে
ভাবছি একদিন তোমাকে ঠিক চুমু খাব কোনও শহীদ কিংবা স্বাধীনতা দিবসে
তোমাকে চুমু খাব সেই পুণ্য, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়

এই রকমই একের একের পর এক কবিতায় অবগাহন করতে করতে লহমা লাগে ষোড়শ মহাজনপদ থেকে” “আড়াই হাজার বছরঅতিক্রম করতে। প্রেমিকের অহংকারের আঁচ এসে লাগে পাঠকমনেও।
দেবলীনা’, এই বইটির আনাচে কানাচে যার পাখির মত বিচরণ, সে হতে পারে চেন্নাইয়ের কোন ধীবর কন্যাবা বাংলার মেয়ে”, রাজকন্যা অথবা আমি। যে মেয়ের অস্তিত্ত্ব এই ভারতের পথে পথে, অলিতে-গলিতে, ঘরের কোণে বা ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট সেক্টরে।
ভালোবাসি বলেই ছেড়ে যাওয়া কঠিন
একটিও লাইন ছেড়ে যাওয়া যায় না। প্রতিটি কবিতা রূপকথার মত, আত্মদর্শনও বটে।
অজান্তেই গুনগুন করে উঠতে হয়...
আশকারা দিও না, আশকারা দিও না এত
আমার সহ্যশক্তি সীমিত
সত্যিই অনেকদিন বাদে এত সুন্দর কিছু কবিতার লাইন, যা স্থায়ী আস্তানা বানিয়ে নেয় মনের একান্ত নিভৃতে। প্রতীক্ষা থাকুক কবির পরবর্তী খাতার। আশা করি কবিও জানেন, “অনন্ত প্রতীক্ষা কারুরই সয় না
সত্যিই বইটি যেন বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। তবুও অতি অল্প সময়ে এক গাঢ় ছাপ রেখে যায় আমাদের মনে। কবি নিজেকে সেই শিখরে উন্নীত করতে অনায়াস সক্ষম, যেখানে তিনি গর্বভরে বলতেই পারেন আমি তখন ভারতের সম্রাট|

Comments

Post a Comment