২১ শে - কবিতা সংখ্যা - প্রবন্ধ






নতুন শতকের দুই কবির কবিতা: ফিরে দেখা
প্রশান্ত হালদার

   মিথ ভেঙ্গে যাচ্ছে, খুব জরুরী ভাবেই, আমাদের পরিপাটি জীবনের ধারণা আমূল বদলাচ্ছে, চিন্তনেরও মিথ খসে পড়ছে, উড়ে যাচ্ছে সস্তা আশ্রয়ের ছাদ। কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন পর্যবেক্ষণ থেকে বেরনো গেলো না “…ours is the age of advertisement.” বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের এ বড়ো সুখের সময় নয়, বাঙালী জীবনের মতোই এ বড় বেদনার দিনকাল।  কথিত,নব্বই-এর হট্ট-মেলা থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো চর্চায় আছেন একুশ শতকের তরুণ কবি-বন্ধুরা, আশার কথা। হৃদয় বলছে, শেষ কবে তরুণ কবির কবিতার বই আঁকড়ে ঘুমিয়েছে বাঙ্গালী কবিতা-পাঠক, তদন্ত-সাপেক্ষ। সুপাঠ্য কাব্যগ্রন্থের অভাব, কিন্তু কাব্যগ্রন্থাধিকারী কবির ভিড়ে খামতি নেই...! নামডাকও হচ্ছে। কীভাবে! ‘আমরা যাবতীয় ঢাকঢোল পেটানোর বিরুদ্ধে’ বলে একদল দামামা বাজাচ্ছে, ‘আর এসো বন্ধু হাতে হাত ধরে থাকি’র অঙ্কে পরস্পর পরস্পরের ‘হরি’নাম আওড়াচ্ছ। এক্ষেত্রে সুখের কথা বাঙালি হিসেবে পরম্পরা বজায় রাখার ব্যাপারে কবি-বন্ধুরা তৎপর; তাদের দল ভাগাভাগির কাছে কমিউনিস্ট পার্টি দশ গোল খাবে নিঃসন্দেহে, সঙ্গতে নব্বইয়ের জনপ্রিয়, অর্ধ-জনপ্রিয়, প্রান্তিক, ফ্রাস্ট্রু ইত্যাকার গুরুস্থানীয় বন্ধুগণ—রুট ভাগ করে নিচ্ছেন ও দায়িত্ব নিয়ে ছাতা ধরছেনসবকিছুর মাঝখানে নতুন ভালো মানের কবিতা হারিয়েছে ‘বাদাম পাহাড়ে’।  ছন্দ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার লড়াইটাই হয়ে যাচ্ছে কবিতা(ছান্দসিক কবি ভাই-বোনেদেরকে না হয় ছাড় দেওয়া গেলো), ‘সিরিয়াস কবিতা-চর্চার’র নামে গুণিতক হারে বাড়ছে কবিতা পত্রিকা, কবি বলছেন, আহা, আর তিনটি হলে এবছর আমার একশো কবিতা প্রকাশ হয়ে যেত! ফর্ম ভাঙ্গার নামে গোবরের পায়েস খাওয়ানোও চলছেদেশে কবিতা বেরয়’ কলকাতার ঘোমটা-ওলা বউয়ের মতো আজ মিথ...আর একদল প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা মানে এখনও ঠারে-ঠরে আনন্দবাজার বা রূঢ়ভাবে বললে দেশ-বিরোধিতাই বোঝান! কি হাস্যকর মর্ডানিজম আজকের ‘পোস্টমর্ডানিজম’-ভাঙ্গা সময়েও! তাই ‘দেশে লিখি না’ গোছের গপ্পো দিয়ে চিটফান্ডের পত্রিকায় লেখা বের করছেন আমাদের প্রিয় বিপ্লবী কবিগণ... ‘দারুণ অর্থাভাবে’।
  এসব অনেক কথার কচকচানিতেও কিছু ‘নাম’ উঠে এসেছিলো ২১-এর গোড়াতেই, পত্র-পত্রিকায় ছড়ানো কবিতা ও অগ্রজ কবিদের কারো কারো লেন্স মারফত, কিন্তু সেই বিষয়ে কোনো সন্দর্ভ লিখতে বসিনি। দুজনকে আজ ফিরে পেয়েছি তাদের দুটি কাব্যগ্রন্থে।
  সম্ভবত ’১৩-এর লিটল ম্যাগ মেলায় চোখে পড়ে ‘নেভানো অডিটোরিয়ামবইটির প্রকাশ ২০০৯-এ। এর আগে শুনেওছিলাম দু-দশ কথা, আর সেদিন তরুণী কবি তথা বই বিক্রেতা বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলো, ‘বইটা কতো বার কিনেছো ও হারিয়ে ফেলেছো?’ যদিও তাকে হতাশ করে আমি বলেছিলাম, ‘একবারো না’, মনে মনে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম আমাদের সময়ের প্রাগ্রসর সেই কবির কবিতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবার আশায়, যাকে চাঁচাছোলা স্পষ্টবক্তা এবং অন্যদের কবিতার শিক্ষিত পর্যবেক্ষক হিসেবেই শুধু জানতাম না, মেধা-চর্চা তথা জ্ঞান-চর্চা তার কবিতার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত বলেই মনে করিকিন্তু কেনার সময় থেকেই মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে সন্দেহের ভূত; অতনু সিংহ তার কবিতার বইয়ের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রাখার জন্য প্রচ্ছদে কেন সাঁটিয়ে দেবে নেভানো অডিটোরিয়ামের আলোকচিত্র! অনেক সময় শেষ মুহূর্তের এইসব ছেলেমানুষি রয়ে যায় ‘সবে মিলি করি কাজ’এ। তাই এই প্রারম্ভিক হোঁচট সরিয়ে খোলা মনে কবিতাগুলো পড়ার সঙ্কল্প নিলাম।
                      কে গো তুমি জল
                      ছায়ায় ভাসিয়েছো শরীর
                      তোমাকে লক্ষ্য করে রাক্ষস বিমান
......এইভাবে শুরু। যথেষ্ট মনোনিবেশের দাবী রেখে পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্মতা তথা সময়ের বিপন্নতার ছবি আঁকা এক ওয়ান লাইনার-সমেত এই তিনটি লাইন আমাকে সেঁধিয়ে দ্যায় অতনু-মহলে।
  অতনুদা বা কবিতার অতনু সিংহ সম্বন্ধে যতটুকু জানি, তার বিশ্বাস, শূণ্য-দশক (আমি যাকে একুশ শতকের তরুণদের রেফারেন্সে চালাচ্ছিলাম) নব্বই-এর বাজারমুখী মায় জয় গোঁসাইমুখী মায় আনন্দবাজারমুখীনতা থেকে দূরে সংসার পাততে চেষ্টা করেছে, ব্রততী অ্যান্ড কোং-এর সস্তা হাঁ তথা ছড়িয়ে যাওয়া ‘ছড়া’-ছড়ি থেকে গদ্য তথা মুক্ত কবিতার দশক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে জাপানী তেলের সাহায্য ছাড়াই(অন্য দিকে আনন্দবাজার জাপানী তেল সহযোগে বাজারে দণ্ডায়মান)।তার বিশ্বাস ২১ শতক নতুন ভাষা, ব্যাকরণ, আঙ্গিক, প্রভৃতির সন্ধানে ব্যাপৃত।
  বাঙালি আমকবিতাপাঠক যে সময় কনডোম, ন্যাপকিন, গোস্বামী, আলু-পটল একসঙ্গে বাজার করে ফিরছিল — সঙ্গে নিতে ভুলছিল না শুভ দাশগুপ্ত, কবিতা হিসেবে বিকচ্ছিল সুবোধ বাবুর ‘রূপম কে একটি চাকরি দিন’, ‘মেয়েটা বিয়েতে একান্নটা শাড়ী পেয়েছিলো’, ইত্যাদি, কবিতাকে, বামফ্রন্ট আমলে কয়েন হওয়া ‘ঘরে লোক ঢুকিয়ে দেওয়া’র মতো, কিচেন-বাথরুম, তথা ডাইনিং টেবিলে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হ’লো, ফলে নব্বইদশক-জয়-আনন্দবাজার-কার্নিভাল যে কবিতা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে সদর্থকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো তা এখন মূর্খের বচন। আর তাই অতনু সিংহ যথার্থ। লক্ষ্য করা গেছে, তার (আনন্দ)বাজার-বিরোধিতা ধান্দাবাজিহীন।
  ট্রাজেডি কিন্তু রয়েই গেলো! ২১ শতকের প্রথম দশকের শেষে পৌঁছে অতনু লক্ষ্য করে শূন্য দশকও বাজারের কাছে ধরাশায়ী! অতনুর দীর্ঘশ্বাস তাকে যথার্থ মরমিয়া ভাবুক হিসেবে/চিন্তক হিসেবে তুলে ধরে।
  ‘নেভানো অডিটোরিয়াম’-এ অতনু যে জগতের বাসিন্দা সেখানে ‘ভাঙ্গা কাচ, জাফরি শরীর ধরে/ হেঁটে যাচ্ছে বিছে’, ‘ছমছমে জঙ্গল রাজারপুর, মাতাল পিঁপড়ের গতিবেগ...’ উল্কিভুল্কি কিছু সাপের নাচন যদিও পুরো বইজুড়ে এরকম কোনো সুনির্দিষ্ট আবহ তৈরির চেষ্টা আছে বলে মনে হয় না, ভালো কথা,(এক্ষেত্রে বইটির তিন ভাগে ভাগ করার বিষয়টি অগ্রাহ্য করছি) আজকের সময়ে এসে বহুমুখীনতার চর্চা ছাড়া চিন্তার মুক্তি বা বন্ধন কোনোটাই সম্ভব না তাই ‘যৌন ইঁদারা, ব্লেডরাখা অতীত’ পেরিয়ে ধারালো অতনু লেখে—
                পদচ্যুত প্রেতের মতো কৌণিক বেগে
                জড়িয়ে গিয়েছি তোমার স্নায়ুদেশে
সেই সঙ্গে এড়িয়ে যায় না আর্তিও—
আ্যতো যে লোডশেডিং, হাওয়া কলে
দিকভুল হারানো রুমাল
আ্যতো যে শিলার গায়ে অন্ধকাঁপন  পশমের গুহা...

অন্ততঃ এক আউন্স আমাকে দেবে না ?
এতোসব সত্ত্বেও অতনু সিংহ কি গতানুগতিকতার ফাঁদ থেকে বেরোতে পারলো ? প্রান্তিকতা কি শুধু মাত্র নামোচ্চারণে আটকে রইলো না(!) যখন সে লেখে—
তোমার কথা গোকুল মাহাতো জানে
..........................................
তোমার কথা কুমার সম্ভব জানে

অদ্ভুত ও বহুজন-ব্যবহৃত এই প্রবণতা— যোগসূত্র স্থাপনের ইশারা; কুমার সম্ভব, চর্যাপদ প্রভৃতি শব্দগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো নতুন জগতে পৌঁছে দিচ্ছে না যে জগত একজন প্রথাবিরোধী বাজার-বিপ্রতীপে বসে থাকা কবির কাছে পাঠক প্রত্যাশা করে। বরং শিকড় খুঁজে চলার এই প্রবণতাই(আর্তি নয়) বহুমুখী ও রাইজোম্যাটিক কবিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েযাহাই ঐতিহ্য তাহার সঙ্গেই গলাগলি, যাহা বহিতেছে তাহাতেই পুন্যার্জন, প্রশ্নহীন,দুশ্চিন্তাবিহীনভাবে এক ২১ শতকের কবি এভাবে ব্রাহ্মন্যবাদিতার হাতে ধরা পড়বে!
  স্বভাবকবিতার দিন শেষ আজকের নয়, ওই মধ্যযুগীয় পরিসরটুকু বাদ দিলে কবিতা-চর্চা নিশ্চিতভাবেই নাগরিক বিষয়। দারুণ ভাবে শুরু হয় এই কবিতাটি:
ভয়ের পরিখা পেরিয়ে চারিপাশ
বায়ুহীন, স্থবির মুহূর্তে ফ্রেম
বেসামাল...
কিন্তু তার পরেই
কিছুটা চারণ দেখেছে জানি
বিষাদ টুকরো গেয়েছে মহীন
নতুন ভাষা ও আঙ্গিকের খোঁজে শেষে ‘চারণ’ শব্দ তথা ‘বিষাদ টুকরো গেয়েছে মহীন’-জাতীয় কাতরতা কবিতার ফর্ম কিম্বা ভাবনার কসরতের দিক থেকে সেই একঘেয়েমিকেই নির্দেশ করে যা আমাদের বাপঠাকুর্দা-কবিরা পরিবেশ ধ্বংস করা কাগজে কাগজে হেগে চলেছেন। তাহলে সমস্যাটা কি এই— চিন্তা-ভাবনায়-তত্ত্বে যে-অতনুকে আমরা চিনি সে কবিতার কাছে এসে কনফিউজড? নইলে তার কবিতায় কেন ‘কানু’! ‘ঈশ্বর’এর বহু-ব্যাবহার রীতিমতো বিরক্তিকর। বনেদী মিথকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে আশা করেছিলাম, বদলে পেলাম ‘কৃষ্ণ বা জেমসবন্ড কোনোটাই নই’জাতীয় দুর্বল বিবৃতি,কিম্বা পুনরায়,কলস, তিনটে রঙে, তিনটে ঋতুর বিভাজন, ভ্রমর গুঞ্জন, হলুদ বাক্স, হলুদ বায়ু, সুরার করোটিপাত্র, কুহক জটিল প্রভৃতি অনর্থক, সেকেলে শব্দবন্ধের মায়ায় আচ্ছন্ন অতনুকে কেমন অচেনা লাগে। বৃদ্ধ পিতা, পিতামহ ভীষণ রকম বিভূতিভূষণীয় যা আধুনিকোত্তর কালপর্বের ভাষা বা চিত্রকল্প হতে পারে না।
  অন্তর্লীন গীতিময়তা শূন্য দশকের কবিতাতে প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে সত্য, তা বলে পেলব (যদি দূর্বল শব্দ নাও ব্যাবহার করি) অন্ত্যমিলেরও ফাঁদে পড়ছে অতনু সিংহ ?



চেয়ে দ্যাখো কতটা উড্ডীন—
টোটেম বৃক্ষের নিচে কয়েকটা ঘাস,
রথের মেলার সিন্.....
সাদামাটা ও দুর্বল পর্যবেক্ষণের উদাহরণ চমকে দেয়:
যেরকম ঘেন্না বলতে বোঝানো হয় থুতু
আর বাবলাগামে আমি বুঝি
বুদবুদে সমান্তরাল যোগাযোগ...
কথা হ’লো ‘এরকম অতনুদা’কে কেন পেলাম ? এর কারণ নিহিত সম্ভবত বাঙালীর সেই চিরকালীন নায়েব বৃত্তি, মোসায়েবিপনায়; আমাদের চারদিকে যারা অমাত্য/পারিষদ আছে তাদের অন্তর্দৃষ্টির কথা ছেড়েই দিলাম, এনজিও সিন্ড্রোম আক্রান্ত এইসব রোগীদের সঙ্গে ওঠাবসাতে আমাদের অর্শ, ফিশ্চুলা তো হবেই। ‘তোমারো পশ্চাদ্দেশে চুমু খামু, তুমিও খাও’ করে করে চলছে। গঠনমূলক সমালোচনা দূরে থাক, ‘ভালো লাগলো না’ কথাটাও কেউ আর মুখের উপর বলে না, হয়তো সেইজন্যই ভালো কবিতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনাগুলো মাঠে মারা যায় এইভাবে—
আঁচড়ের এই শূন্য প্রহর থেকে
ফের আঁকা শুরু হলো সিঁড়ির মহড়া
হলুদ বায়ুর ভারে আপাতচঞ্চল
আ্যশট্রের মুখোমুখি তোমার
গোপন কথন লেগে আছে রিসিভার জুড়ে
পাঁচটার কলে জল এসেছে
এসেছে পদ্মপুকুর, ভ্রমর গুঞ্জনে বান্ধবীর হাসি—
উড়ে উড়ে সিঁদুরর বেদনায় লীন...
কাকেদের বিষণ্ণ অ্যান্টেনায়
শুরু হলো দিগন্ত যাপন, অঙ্কখাতা জুড়ে

এ মুহূর্তে ডেকে উঠছি মা কালীকে
দেয়ালের দিকে লাজুক হাসছে বিছানা
জানালার ব্যাপ্তি জুড়ে উড়ন্ত হাঁসের পৃথিব...
তুমিও নাকি কফ্ সিরাপ ভুলে
গেয়ে উঠছো আখতারি বেগম!

যে কবি লিখছেন আঁচড়ের এই শূন্য প্রহর থেকে/ ফের আঁকা শুরু হলো সিঁড়ির মহড়া তিনি কিভাবে হলুদ বায়ু দ্বারা আক্রান্ত! পদ্মপুকুর, ভ্রমর গুঞ্জনে বান্ধবীর হাসি সুলভ চটুল রোমাঞ্চ-পংক্তিতেই বা কিভাবে মজেন বোঝা দুষ্কর। আসলে তিনি তো বেদনায় লীন...! আর তাই আখতারি বেগম, সরোদ, কুমার সম্ভব, ইলিয়াস ইলিয়াস শব্দ থেকে ইলিয়াস ইলিয়াস শীৎকারে খড়ের গাদায় জন্ম নিচ্ছে শহরের ঈশ্বর। এ হেন রেফারেন্সিয়াল হয়ে ওঠা, আভিজাত্য প্রকাশক বনেদি চিত্রকল্পের অতনু সিংহকে চিনি না। অতনুদা আমদের সময়ের একজন অভিভাবকস্থানীয় সমকালীন কবি যে সমকালের কবিতা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে যথাযথ পর্যবেক্ষক হওয়া সত্ত্বেও নিজের কবিতার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। পরবর্তীকালে প্রকাশিত তার অপর লিখিত মোনোলগ কয়েকটি প্যারালাল কাট্ গদ্যপুস্তিকাটি এখনো সংগ্রহ করা বা পড়া হয়ে ওঠেনি; পড়তে চাই, আরো কিছুদিন পর......যথারীতি সমালোচনার উদ্দেশ্যে নয়, উপভোগ করবার পুনঃচেষ্টায়।

 অতনুর সমসাময়িক অনুপম মুখোপাধ্যায় ইতিমধ্যে ছ’টি কাব্যগ্রন্থের অথরশিপ অর্জন করেছেতার প্রথম কাব্যগ্রন্থ রোদ ওঠার আগে’(২০০৬) প্রকাশের আগে থেকেই বাঙালি অনুসন্ধিৎসু কবিতা-পাঠকের কাছে সে আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। ২০০৪-০৬ সাল নাগাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার কবিতা পড়ে একজন সমকালীন প্রাগ্রসর কবিকে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির অ্যালবামে আবিষ্কার করতে পেরে উত্তেজিত বোধ করতাম। প্রতিভার স্ফুরণের ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম তার ‘অন্যরকম’ কবিতায়, সম্ভবত তখন অনুপমদা তার পড়াশোনার পরিসর বেশ সচেতন ভাবে বাড়ানো শুরু করেছে, আত্মীয়তাবোধ বাড়ছিলো।  অত্যুক্তি হবে না, দীপাংশুর মতো ছিটকে বেরনো সম্ভাবনাময় এবং দীপাংশুর বিপরীত দিক থেকে শুরু করা কবি হিসেবে অনুপম মুখোপাধ্যায় ছড়িয়ে পড়ছিল পাঠক-মননে২০০৭ সালে বেরনো যার নাম অপরাজিতা সেও কিন্তু নামকরণে হেরে যায় বেরনোর পর তার সম্বন্ধে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম। এতো দুর্বল একটি বাক্য কবিতার বইয়ের নাম হয়ে উঠতে পারে তা ভাবতে গিয়ে কেন্দ্রসরকারী বাংলা বিজ্ঞাপনের লাইনগুলোই মনে ভিড় করছিলো। ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ তো ছিলই! যাকগে সেসব বহু বহু দিনের কথা। ইতিমধ্যে বছরখানেক আগে পদ্যপত্রের সম্পাদকের কাছ থেকে ‘অনুপম % মানুষরা (২০১২) পেলাম। এটি তার ষষ্ঠ তথা শেষতম কাব্যগ্রন্থযতই তার প্রতি অন্যমনস্কতা দেখাই, যথারীতি প্রত্যাশার পারদ চড়লো পরীক্ষা-নিরীক্ষার চরম কিছু নজির দেখবার।

  অনুপম সিনেমা-আক্রান্ত। জাম্প-কাট তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঘোষিত এবং ফলিত অর্থেই পোস্টমডার্ন, অযুক্তির জাক্সটাপোজিশন তাকে চিনিয়ে দেয়। কবিতায় লিরিকপ্রবণতার সমস্ত সম্ভাবনা মুছে দিতে চেয়েছে অতি তরুণ বয়সেই।

  অনুপম সম্বন্ধে একজন অগ্রজ কবি/প্রাবন্ধিক/চিন্তক বলেছেন, শূন্য দশকের সবচেয়ে সিনিয়র ও পরিণত কবি অনুপম বহুপ্রসু এবং অ্যাম্বিসাস; তাঁর প্রত্যয়, তার (অনুপমের) দিকে তো তাকিয়ে থাকতেই হবে আমাদের। তাই পাঠককে এই পঙক্তিগুলোর দিকে তাকাতে অনুরোধ জানাই...
অনেক সাদা ঘাসের মধ্যে একটা সাদা ঘাস...
একটা বালিশ যেমন হয়
একটা কবিতা দুবার পড়লে মায়া নেমে আসে
চায়ের প্যাকেটে একটা ফুটো
খুব পুরনো একটা বাড়ি
আর খুব রোদ ঝলমলে একটা সকাল
একটা ঝলমলে সম্পর্ক ভেঙেই যায় হঠাৎ
একটা নদী— নিজের নদী যাচাই করে নিচ্ছে
একটা ফুলগাছ তার সব ফুল উপুড় করে
কোকোনাট একটা গাছের নাম
সিসিফাস একটা গাছের নাম
প্রশ্নের মধ্যে কি একটা বেলুন থাকে
দেয়াল তো আয়না নয় যে আস্ত একটা কবিতা ঝুলে থাকবে
পার্সে একটা একলা একশো টাকার নোট
হারিয়ে গেলো চাঁদের একটা টুকরো
এমন একটা জ্যোৎস্না
হৃদয় একটা ভেজা মাংসপেশী
একটা ইন্দ্রিয়ে মিশে যাচ্ছে অন্য ইন্দ্রিয়
হৃদয় একটা শুকনো মাংসপেশী
বুঝতে পারছি কোন একটা মেইন রোডের মোড়ে/জমজমাট বাজার বসেছে
যেমন একটি নগ্ন মেয়ে আরেকটি নগ্ন মেয়ের/ছবি তুলে দেয়...
যেমন খুব পুরনো একটা হোটেলে/খুব পুরনো একটা লোক/নতুন একটা কুকুরের শেকল ধরে ঢোকে...
একটা ব্রিজ— শিখছে কাবাডির নিয়মাবলী
শরীরের সেরা বন্ধু অন্য একটা শরীর
তুমি একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী
ভালো... খুব... খুব সুন্দর একটা মুখ
ঘরের ভিতর একটা পাতা

উপরের লাইনগুলো সমস্তই অনুপমের আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। মোট ৪৮টি কবিতায় ২৯ বার ‘একটা’/’একটি’ শব্দের ব্যাবহার আমাকে আকৃষ্ট করে এই বইটির সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত বারীন ঘোষাল মহাশয়ের প্রতি। অনুপম সম্বন্ধে বারীনবাবুর মতামত(প্রশংসা) উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোর অব্যবহিত আগেই হাজির করেছি। শ্রদ্ধেয় কবি/প্রাবন্ধিক/চিন্তক বইটির শুরুতে ‘অসম্পদনার কথা’তে বলছেন অনুপম সম্বন্ধে, ‘শব্দকে যেভাবে সে নিঃশব্দ করেছে ধ্বনির রণন মুছে...’, ‘...প্রতিকীয়তার বাইরে মিথমুক্ত করেছে...’ ইত্যাদি। এই অসম্পাদনা কথাটিই এত শিশুসুলভ কেরামতি যে খুব স্বাভাবিক প্রবণতাতে দেড় পৃষ্ঠা সম্পাদক(কবিতা নির্বাচনকারী) কা বাত না হলে মন্দ কি টাইপের বাতাবরণ তৈরি করেছে। ও ভালো কথা এক পৃষ্ঠার কবিকথাও আছে যা শুরু হচ্ছে এইভাবে, ‘আবার একটা বই হবে আমার, এটা ভাবলেই শরীরটা কাঁপে...’ কবিতার এই নান্দীমুখ সাধারণত এত অগভীর ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে তা ব্যাতিক্রমহীনভাবে বকবকানি ছড়া কিছুই মনে হয়নি। প্রথম কবিতা...
পা
ছড়ানো পা
রোদে ছড়ানো পা
........................
.................................
রোদে ছড়ানো কালো পায়ে রূপার উদ্ভাসিত নূপুর
রো
মাঝের দুটি লাইন ‘শূন্যস্থান-পূরণ’ হিসেবে পাঠকের জন্য রাখলাম। ইলাস্টিক বাক্যের উদাহরণ বলা যেতে পারে। জ্যামিতি ? বিনয়ের অঘ্রানের অনুভূতিমালা’  পড়ুন, কবিতায় জ্যামিতিক ওঠা-পড়া কাকে বলে বিশদে দ্রষ্টব্য। অনুপম শব্দের মিথ ভাঙতে গিয়ে লিখছে ‘শূন্যে হাত বুলিয়ে শূন্যের গোল রং খুঁজছি...’ এ সবই সে বলছে গোদারের রেফারেন্সে; আর শেষ করছে এই বলে— ‘কৃষ্ণচূড়ার বোতল থেকে/ কোকা কোলা উঠে আসছে... গোদার...’ স্যাটায়ার ? ‘ঝিনুকের এঁটো খোলা, শ্যাম্পেনের ব্যবহৃত বোতল/ ঘুম ছুঁয়েই থাকে’ স্যাটায়ারিকাল জাক্সটাপোজিশন ? তাই কি লিখছে— ‘বসন্তকুঞ্জের নিচে/ শুয়ে আছে প্লাস্টিক মানুষ’...? পুরনো শব্দবন্ধ ও নতুন ভাবনা-জারিত সাইবার শব্দ ব্যবহার সহযোগে বৈপরীত্য নির্মাণ বহুব্যবহৃত প্রবণতা শুধু নয়, টেকনো পৃথিবীর স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে তাকে ভেংচি কাটা একরকমের পলিসি; যদি তা না ও হয়, অতিসাধারণ পর্যবেক্ষণের পাতি ব্যবহার তো বলাই যায়। তাই ‘লালন সাঁইয়ের গান ডাউনলোড করেই/ একতারাটা চাপা দিয়ে রাখি’গোছের ভাবনা প্রযুক্তির অতি-উপস্থিতিজনিত সস্তা দুঃখবোধ যা শুধু কাব্য করবার ছেনালিতে দুর্বল নস্টালজিকতার হাজিরাই মনে হয়। কাব্যগ্রন্থের শেষ (দীর্ঘ)কবিতাতে তথাকথিত কাব্যভাষাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়—
আবার ঘোরাই ভাষা এই কথা বলে
মধ্যপদলোভে আমি কোনকালে নাই...
গোপন মলাট ... প্রদীপ ম্যাজিক ... ঝলক বুদবুদ ...
দরজা খুলে সোজা আমদের
অপচয়ে ... মায়ায় ...
অ্যাতই ভিতরে ...
আমাদের কবিতাকে কেউ বিশ্বাস করছে না ...
আইরে বাইরে নামের কবিতা এরকম......যেমন ধ্বনির রণন মুছে দেওয়ার নাম করে অনুপম শীৎকারে ... শীতকালে ... চুষে রেখে দেব’  জাতীয় অনুপ্রাসের আশ্রয় নেয় এবং কবিতার মধ্যে রিফ্রেন হিসেব কিম্বা ভাইস ভার্সাফিরে ফিরে আসে। ... তার যোনি.../ প্যান্টি কেটে আমরা তার বর্ষাকাল চাইছি...রা আর গুরুত্ব পায়না। দুর্বলতাই প্রকট হয়...ধ্বনি নির্ভরতার দুর্বলতা। যদিও  ধ্বনি নির্ভর উৎকৃষ্ট কবিতা বাংলা ভাষায় রয়েছে,কিন্তু বাঙময়তা তো দূরে থাক ধ্বনি-নির্ভর কবিতা হতে গিয়েও ডাহা ফেল, অনুপমের কবিতা যেন হাজার কিছু বলতে চায়, খেই হারিয়ে ফেলে যেখানে-সেখানে।
 পুরনো অনুপম বেরিয়ে আসে ...দাড়িতে বাতাসের খামখেয়ালিপনা নিয়ে, আর উপলব্ধিও করে যেন তুমি নয়      তোমার আয়না তোমাকে ভেংচি কেটে দিলো’; আমার মনে পড়ে এক অগ্রজ কবির লেখাদুটো আয়না মুখোমুখি এসে/ ওকে বাতিল করে দেয় কিন্তু অনুপমের এহেন পঙক্তিযুক্ত কবিতা শুরু হচ্ছে এই বলেশীতের রাত বললেই কি বাঁকা চাঁদ বলতে ইচ্ছা করে...স্বগতোক্তি? বাঁকা প্রশ্ন? দুর্বল, কিশোর-সুলভ বাক্যসমন্বিত এসব কবিতায় অনুপম নানান কিছু প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, যেন কোনো টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। দুনিয়া নামের কবিতাটির পূর্নাঙ্গ দর্শন করা যাক।
রোদের ছাপ থেকে ছায়ার ছাপে পা বাড়িয়ে দিলাম

শব্দ হল— ছপ্ !

এখানে তো স্নান করতে চাইনি
এখানে তো জাল ফেলতে চাইনি

আমি তলিয়ে যাচ্ছি ঘাসভরা মাঠে—
তোমরা সেই ছবি তুলে নিলে !
প্রথম বাক্যের অনুপ্রাস-দুর্বলতা বাদ দিলেও পড়ে থাকছে ‘পা বাড়ানো’ সংক্রান্ত হাজারো রেফারেন্স, তার মধ্যে একটি পা ফেলার শব্দ...তারও হরেক কিসিম...কবি বেছেছেন ‘ছপ্’...ফলে স্বাভাবিকভাবে জলে পা ফেলার প্রসঙ্গ খাড়া হয়...জল ভেবেই অনুপম স্নানের দিকে যায় কিম্বা জাল ফেলবার দিকে, ইত্যাদিএবং পাঠক বুঝতেই পারছেন শেষ লাইন এসে যায় ভাবনা ও দৈনন্দিন বাস্তবতার খটাখটি থেকে কিন্তু তাও শেষ পর্যন্ত কল্পবাস্তবতার সার্থক রূপায়ন হয়ে ওঠে। এই যে থ্রেড(সুতো/ছুতো) তৈরি করে এগোনোর চেষ্টা কবিতার শুরু থেকে এবং অযুত সম্ভাবনার থেকে একটিকে বেছে নেওয়ার প্রবণতা কবিতাকে সঙ্কীর্ণ শুধু করেনা এই প্রক্রিয়া কবিতা লেখার প্রাথমিক পর্যায়ের মহড়া হয়ে দেখা দেয়। পোস্টমডার্ণ কবিতা কি একেই বলে বর্ষীয়ান সম্পাদক(অসম্পাদক) মহাশয়? পোস্টমডার্ণ কবিতা এত রেফারেন্সিয়াল!...মিথের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা ছাড়া তার কোনো গতি নেই...??? একজন শক্তিশালী কবির লেখা লাইন ‘এটা শ্রাবণ না এটা ফাল্গুন...’! তারপর সে লিখছে ‘একটা ফুলগাছ তার সব ফুল উপুড় করে/ দাতাকর্ণ সাজছে...’এত অবৈজ্ঞানিক (পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না-র মতো) বাক্য পড়ুয়া-অনুপমের কাছে বা সম্পাদক মহাশয়ের কাছে প্রত্যাশিত ছিল হয়তো আর তাইতো অব্যবহিত পরে ‘দাতাকর্ণ’ মিথের আশ্রয়ে উপমা তৈরি হচ্ছে। দাদা, মিথকে দুর্বল ভাবে বিনির্মাণ(?) না করে নিজে মিথ তৈরি করুন না একজন যথার্থ সৃষ্টিশীল কবি হিসেবে। মিথের আশ্রয়ে ঐতিহ্যের ছাতার তলায় মাথা-নত সৃজনশীল শিল্পচর্চাকারী মূলগতভাবে প্রতিবন্ধী, যদি না তিনি এলিয়টীয় ভঙ্গীতে মিথের দুর্নিবার আশ্রয় সত্ত্বেও বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন শতাব্দীর যন্ত্রণাধারণে। না অনুপমের মধ্যে এখনো পর্যন্ত এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।আর তাই সে লেখে— ‘জামপাতায় ঠিকরে আসছে জামরুল পাতার রোদ’জাতীয় বাক্য— যার অনুপ্রাস ও রেফারেন্স সমন্বিত পর্যবেক্ষণ আমাদের শিল্পবোধের কোন স্তরে উন্নীত করে বুঝতে পারি না। এসব দুর্বলতার মাঝখান দিয়ে অনুপম ‘প্যালেস্টাইন’ কবিতাতে ফুটে উঠছে—
মজা নেই। আমোদ নেই। পাগলামো আর বিষাদের স্তরদুটোকে
একসঙ্গে চটকানো হচ্ছে।

ব্যস্ত ব্যস্ত ট্রাফিক। দুটো স্তন স্তব হয়ে দুলছে।
শান্ততাই বুনে ফেলবে হাল্কা ল্যান্ডস্কেপ।

বেড়াতে যাওয়ার টিকিটগুলো সিনেমার টিকিট হয়ে যায়...

খিদের পা, আমোদগেঁড়ে পা... টেনে নিচ্ছে রাস্তা।

কে বলবে পিচ গলছে ?

  অনুপমের কবিতায় (স্টিকিং প্লাস্টারের / দেভ ডি / কাগজ কে ফুল প্রভৃতিতে) সিনেমার রেফারেন্স এসেছে; এও একধরণের মিথ ব্যাবহারের অপচেষ্টা আর তাই ‘তোমার বাগানে ফেলে এসেছি গুরু দত্ত-র তামাক’জাতীয় বাক্য হাস্যকর, হাস্যকর শ্রবণ থেকে নয়ন সরালেই.../ চন্দ্রমুখীর মাদুর  Big mediaকে শ্রেষ্ঠ শিল্পমাধ্যম ভেবে নেওয়ার জোয়ারে ভেসেছে অনুপমও;সেজন্যই সিনেমার রেফারেন্সের কাছে নতজানু হওয়া। কবিতা এমন ভাবে সিনেমা থেকে উঠে আসছে যেন সিনেমার আশ্রয় কবিতাকে বাঁচিয়ে দিলো...! তাহলে কবিতা না ‘করে’ সিনেমা করলেই তো হয়।
  অনুপমের কবিতায় ‘দ্বিধা থর থর’ শব্দবন্ধের ব্যাবহার রয়েছে, কিন্তু কোথাও কোনো সংশয়-যুক্ত প্রকাশভঙ্গী পাওয়া যায়নি(সংশয়হীন শিল্পী!!!), বরং এবসলিউটিস্ট বিবৃতি তাকে চিহ্নিত করে—
যেকোনো ভালো গ্রামে বাচ্চাদের রেলস্টেশন থাকে
স্টেশনমাস্টার হল পশুচিকিৎসক
নৈর্ব্যক্তিকতা পরিসর পাচ্ছে না! যদি না কোনো নিদারুণ প্রকাশভঙ্গী/ চমকে দেওয়া/ ভাবনার কোনো নতুন জগতে পৌঁছে দেওয়ার সফল ষড়যন্ত্র থাকে এই ধরণের subjective observation নিজের কোঁচড়ে রেখে দেওয়াই ভালো। বস্তুত absolutism-এর চর্চা একজন কবিকে কোয়ান্টাম/ প্রোবাবিলিটির জগত থেকে ভীষণভাবে পিছিয়ে নিয়ে যায়; এক্ষেত্রে পোস্টমডার্ণ কবির স্ববিরোধিতা প্রকট আকার ধারণ করে।
  অযুক্তির স্পেস ব্যাবহার করে বাক্য সাজানোর চেষ্টা অনুপমের আছে, সেসব খুব একটা শক্ত-পোক্ত নয়, কোথাও কোথাও সামাজিক বিবেক হয়ে ধর্মেও আছি কোকাকোলাতেও আছি গোছের চেষ্টা লক্ষণীয়। আনন্দ-দুঃখ-রাগ, রসাত্মক আবিষ্কারমুখী প্রবণতা, ইত্যাদি কিছুরই দেখা মেলে না। কিছু না-বলতে চাওয়ার আনন্দ বা যন্ত্রণাবোধেরও কোনো প্রকাশ নেই! এ  এক অদ্ভুত দুনিয়া তৈরিতে ব্যস্ত অনুপম আটকে আছে বাহ্যিক কাঠামো নির্মাণে( form কে বাহ্যিক কাঠামো ভেবে বসবেন না দয়া করে)। আসলে প্রাথমিক পিঠ চাপড়ানিতে আপ্লুত অনুপম নিজেকে বাংলা কবিতায় নতুন শতকের চ্যাম্পিয়ন ভেবে বসেছে ফলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে (তার নিজস্ব তত্ত্বনির্মিত পুনরাধুনিক পর্যায়ের কয়েকটি কবিতা ইতিমধ্যে চোখে পড়ার দরুন আরো জোরের সঙ্গে বলা যায়) , বেরিয়ে উড়ছে কবিতার এলাকা থেকে দূরে নার্সিসিস্ট গ্রামে; আর বারীন ঘোষালরা ‘তোবা তোবা’ করছে তরুণ কবিদের আড্ডাপালোচনায় নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখার লোভে আক্রান্ত রোগীর মতো এইসব লেখালিখির(কবিতা ইত্যাদি) নামে ছড়ানো দূষণ নিয়ে মাতামাতি করছেন। তথাকথিত মেনস্ট্রীমে জনপ্রিয়তা নামক অশ্লীলতার হাত ধরে  সুনীল-জয়কৃষ্ণ-(আনন্দ)বাজার যে ক্ষতি করেছে বাংলা কবিতা-পাঠক তথা পাঠ-সংস্কৃতির, উল্টো দিক থেকে পাল্টা-স্রোতের ‘উৎপল-বিনয়’জাতীয় তথাকথিত প্যারালাল কবিতাচর্চার সংস্কৃতিকে ঘুলিয়ে দিয়ে না-গঠনমূলক-না-ধ্বংসাত্মক— সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী কিশোর-সুলভ আয়োজন মারফত অনুপমের মতো কেউ কেউ কবিতার বিরুদ্ধে নেমে পড়েছে। অথচ অন্যকিছু হতেই পারতো

                                                                 

পুনশ্চ:- ‘পদ্যপত্র’ পত্রিকার ঋণ স্বীকার করে এই লেখাটি যে কোনো জায়গায় পুনর্মুদ্রণযোগ্য 

Comments