মোর ভাবনারে - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

|


‘কে বেশি বোঝাবে কবি না কবিতা... পদ্যের দায় নেই হিসেব দেবার’  
প্রথমে যে দুটো  জিনিস বলার, ‘সূক্ষ্মতা’ জিনিসটি সর্বজনীন নয়। সবার কাছে তা’ আশাও করা যায় না। দ্বিতীয়ত, আমাদের বাঙলায়, বাঙলা সাহিত্যে সমালোচক শ্রেণি ব’লে স্বতন্ত্র  কোনো শ্রেণি দেখা যায় না। যের’মটা পাশ্চাত্যে দেখি। এবং ‘প্রশংসা’/‘নিন্দা’ এই পথপরিক্রমার ওপারে গিয়ে সমালোচনাটিকেই সাহিত্য ক’রে তোলার প্রয়াস এ’ বঙ্গে দুর্লভ। প্রকৃতপক্ষে, প্রশংসক/তোষামোদকারী এবং আক্রমণকারী— দুজনেই একই শ্রেণিভুক্ত মানুষ। সমালোচকের ছদ্মবেশে এ’ বঙ্গ-ভাণ্ডারে এই শ্রেণিটিরই দেখা মেলে প্রচুর। এবং বলা বাহুল্য, প্রশংসক/তোষামোদকারী/আক্রমণকারী এবং সমালোচক— এ’ দুজন আলাদা ব্যক্তি। আপনার লেখাটি প’ড়ে আপনাকে এই প্রথম শ্রেণিভুক্ত [আক্রমণকারী] বলে ভাবতে ইচ্ছে করলেও, আমি তা’ ভাববো না। ভাবছিও না। কেননা আপনার এই লেখাটি আপনার সমগ্রতার একটি খণ্ডাংশ। আর যেহেতু, আপনার অন্য কোনো লেখাও আমি পড়িনি; ফলে, খণ্ড দিয়ে একটি মানুষকে বা তাঁর লেখার সামগ্রিতাকে যাচাই করা বোকামি। কেননা, আমি বিশ্বাস করি, মানুষ অনেক রকম। একই মানুষ কখনো সাপ হয়ে কামড়ায়, কখনো ওঝা হয়ে বিষ ঝাড়ে।
আমার এই লেখাটিতে আমি অতনু সিংহ এবং অনুপম মুখোপাধ্যায়-এর বই দুটো [‘নেভানো অডিটোরিয়াম’ এবং ‘অনুপম % মানুষরা’] নিয়ে কিছুই বলব না। বলার কোনো যোগ্যতাও আমার নেই। কেননা আমি কবিতা বুঝি না। কোনোকালে বুঝিওনি ও জিনিসটি। ও বিষয়ে আমি মূর্খ। ভাবনা-চিন্তা নিয়ে বলার চেষ্টা করব কিছু। যে ভাবনাগুলো, জিজ্ঞাসাগুলো, শ্রীপ্রশান্ত হালদারের লেখাটি প’ড়ে আমার মনে পুনরায় জেগেছে।      
কোনো প্রব্লেম বা থিওরিকে প্রমাণ করার জন্য কাব্যের দরবারে উকিলের কোট প’রে কবি কি ঢোকেন কখনো? আমার মনে হয় ঢোকেন না প্রতিটি কবিতার নিজস্ব একটি বাস্তবতা থাকে।  নিজস্ব তত্ত্ব থাকে। কিন্তু সে তত্ত্ব থিওরি-বইয়ের তত্ত্বের সাথে লাইন ধ’রে ধ’রে তাল মিলিয়ে হাঁটে না। কাব্যের কোনো দায় থাকে না তত্ত্ব প্রমাণের। তত্ত্ব যদিও থাকেও তার মধ্যে, তবু কাব্যের রূপ ও রস ও কাব্যের নিজস্ব বাস্তবতার থেকে বেশি বড়ো নয় কোনো তত্ত্বই। ‘মেঘদূতে’ও তত্ত্ব আছে। ‘মেঘনাদ বধে’ও আছে। কিন্তু তথাকথিত তাত্ত্বিকতার ওপারে গিয়ে তা’ অন্য কোনো সামগ্রিতাকেই নির্দেশ করে। সমগ্র থেকে খণ্ডকে নির্দেশ করলে ব্যাপারটা কোনোভাবেই সমগ্রর চেতনাকে/চেতনাহীনতাকে প্রকাশ করে না। ব্যাপারটা তখন রবি ঠাকুরের সেই কথাটার মতো হয়ে যায়, আমি যাকে বলি নৌকা বাওয়া, তুমি বলো দাঁড়-টানা। যে কাব্যকে আমি বলি রামায়ণ, তুমি বলো রাম-রাবণের লড়াইঠাকুরের কথা যখন এলোই, ওঁকেই কোট করি সরাসরি, ‘‘শতরঞ্চ খেলার আগাগোড়াই খেলা—মাঝখানে দাবাবড়ে চালাচালি এবং মহাভাবনা। সেই দুঃখ না থাকিলে খেলার কোনো অর্থই থাকে না। অপর পক্ষে খেলার আনন্দ না থাকিলে দুঃখের মতো এমন নিদারুণ নিরর্থকতা আর-কিছু নাই। এমন স্থলে শতরঞ্চকে আমি যদি বলি খেলা আর তুমি যদি বল দাবাবড়ের লড়াই, তবে তুমি আমার চেয়ে কম বৈ যে বেশি বলিলে এমন কথা আমি মানিব না।’’ তো, কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠক/সমালোচক যদি কসরতে বসেন কোথায় পোস্টমডার্নত্ব রয়েছে কোথায় নেই, তাহলে ব্যাপারটা পালোয়ানগিরির পর্যায়ে পড়ে। সৌন্দর্যের পর্যায়ে নয়। আর সমালোচক যদি কবির ‘পলিসি’ই খুঁজবেন, তবে তাঁর ব্যাঙ্কে খোঁজ করাই তো ভালো ছিল। জীবনের খণ্ডাংশকে যেমন জীবনের সমগ্রতার সাথেই মিলিয়ে দেখাটা সঙ্গত, তেমনিই কবির ও কাব্যের ক্ষেত্রেও।    
সমালোচক দেখিয়েছেন অনুপমের বইতে ‘মোট ৪৮টি কবিতায় ২৯ বার একটা’/’একটিশব্দের ব্যবহার’ এবং এর ফলে তিনি সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত বারীন ঘোষাল মহাশয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন [আপনি ‘সৎকার’ পড়েছেন প্রশান্ত? না প’ড়ে থাকলে প’ড়ে ফেলুন। বারীন ঘোষালের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একটি ভদ্রস্থ কারণ উপস্থাপিত করতে পারবেন তাহলে] রবীন্দ্র-কাব্যে আমরা প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাই, ‘খেলা’, ‘ছুটি’, ‘আনন্দ’, ‘লীলা’—এই শব্দগুলিজীবনানন্দে পাই বহুল ‘—’ চিহ্ন। ‘মতো’, ‘ঢের’। রমেন্দ্রকুমারের একটি এগারো লাইনের কবিতায় যখন চারবার দেখা যায় [নামকরণ সহ] ‘পতন’ শব্দটি, তো, তখন এর পেছনে কবির কোনো উদ্দেশ্য আছে বৈকি বলেই বুঝতে হয়। এর ফলে সমালোচক কার প্রতি আকৃষ্ট হবেন জানতে ইচ্ছে হ’ল আমার। আসলে, যখন একজন কবি কোনো শব্দকে একাধিকবার স্থান দিচ্ছেন তাঁর কবিতায়, তখন জানি তিনি কোনো একটি কাব্য-সত্যকে পেয়েছেন, এমন একটি ট্রুথকে তিনি পেয়েছেন, যেটি তাঁকে ছাড়ছে না। একজন মিউজিসিয়ান যখন তাঁর সঙ্গীতে কোনো নোটের ওপর বারবার ঝোঁক দিচ্ছেন, বারবার আণ্ডারলাইন ক’রে দিচ্ছেন কোনো স্বর বা নোট বা শব্দকে, তখন তিনি নিশ্চই কিছু দেখাতে চাইছেন বিশেষ ক’রে। অন্তত আমি এমনটাই বুঝি।     
সমালোচক বলেছেন, ‘‘এই যে থ্রেড(সুতো/ছুতো) তৈরি করে এগোনোর চেষ্টা কবিতার শুরু থেকে এবং অযুত সম্ভাবনার থেকে একটিকে বেছে নেওয়ার প্রবণতা কবিতাকে সঙ্কীর্ণ শুধু করে না এই প্রক্রিয়া কবিতা লেখার প্রাথমিক পর্যায়ের মহড়া হয়ে দেখা দেয়।’’ ক’দিন আগে দেবাদৃতা বসু-র একটি গল্প পড়ছিলামসে গল্পে একটা কথা আমার ভাবনাকে আরো একধাপ এগিয়ে দিল নতুন একটা ভাবনার দিকে। দেবাদৃতার লেখায় পেয়েছিলাম, ‘‘মানুষ তার জীবনে বহু সম্ভাবনা এবং বিকল্পের সম্মুখীন হয়যার মধ্যে থেকে তাকে একটিমাত্র রাস্তা বেছে নিতে হয় অন্য সম্ভাবনাগুলি কিন্তু কখনো বন্ধ হয় না। প্রত্যেকটি বিকল্পের অস্তিত্ব আছে এবং তাদের ওপর নির্ভর ক’রে তৈরি হয় অসংখ্য অপার বাস্তব এবং সমান্তরাল মহাবিশ্ব। অর্থাৎ, তোমার অস্তিত্বই তোমার একমাত্র এবং অনন্য নয়। তোমার জীবনকালে যা যা ঘটতে পারত, তা সবই ঘটে চলেছে বা তুমি ঘটিয়ে চলেছ অন্য এক বাস্তবে।’’ কবিকেও তাই-ই। কবিতাতেও তাই-ই। একটা কবিতা লেখার সময়, কবিও সম্মুখীন হন একাধিক বিকল্প শব্দ এবং লাইনের। একটা কবিতার বহু বহু রকম সম্ভাবনা তাঁকেও ঘিরে ধরে। তাঁকেও বেছে নিতে হয় ঐ যেকোনো একটাই। সমালোচক যে প্রবণতাকে সঙ্কীর্ণ এবং কবিতা লেখার প্রাথমিক পর্যায়ের মহড়া বলেছেন, বস্তুত মানুষ এই প্রবণতাই কাজে লাগায় আজীবন তাঁর জীবন ও সৃজন-কার্যে। রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘‘বাস্তবই হচ্ছে মানুষের জ্ঞাত বা অজ্ঞাত-সারে বাছাই-করা জিনিস।’’ কথাটা ভেবে দেখবার। জীবনানন্দ যখন লেখেন, ‘হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’, কেন তিনি লিখলেন না, হাজার বছর আমি ঘুমাইতেছি পৃথিবীর কোলে কিংবা হাজার বছর আমি ছুটিতেছি পৃথিবীর মাঠে। ‘হাঁটা’ এবং ‘পৃথিবীর পথ’কেই কেন তিনি বেছে নিলেন। ঠিক কোন্‌ তাড়নায় এবং দর্শনে একজন কবি এতগুলি সম্ভাবনা ও বিকল্পর থেকে একটিকেই বেছে নেন? এবং কেন? এবং কিভাবে কবিতায় একটি সম্ভাবনা/বিকল্পকে বেছে নেওয়ার পরেও সচল থাকে অন্য সম্ভাবনাগুলি? এবং সেই অন্য সম্ভাবনাগুলির থ্রেড ধ’রে পাঠক কিভাবে পোঁছন আরেকটি সমান্তরাল কবিতায়? তাহলে কি একটি কবিতায় কবি যা যা ঘটাতে পারতো, তার সবগুলোই পাঠক ঘটিয়ে চলেন বা ঘটাবার সম্ভাবনা রাখেন অসংখ্য অন্য অন্য কবিতায়? থ্রেড তৈরি ক’রে এগোনোর যে প্রবণতাকে সমালোচক দেখিয়েছেন, প্রচণ্ড স্পষ্টভাবে তা’ আমরা শ্যামল সিংহের কবিতাতেও পাই। দু’টি কবিতা পড়া যাক—





শিশুটি পাতা টিপছে
ছিটকে পড়ছে আলো
শিশুটি আলো টিপছে
উঠে আসছে নদী
শিশুটি নদী টিপছে
ছুটে আসছে মানুষ
শিশুটি মানুষ টিপছে
ছুটে আসছে অস্ত্র
[অস্ত্র/শ্যামল সিংহ]  




মাঝরাতে লোকটি বাড়ি ফিরলো
তখন আকাশ থেকে মদ পড়ছে
তখন গাছ ফেটে মদ পড়ছে
তখন মাটি ফেটে মদ পড়ছে
দূর থেকে উড়ে এলো কূলো
কূলোয় চেপে উড়ে এলো পরী
লোকটি পরীকে জড়িয়ে ধরলো
পরীর পা ফেটে রক্ত পড়ছে
লোকটি মদের অনুবাদ করলো
      রক্ত
রক্ত নিয়ে লোকটি ঢুকলো ঘরের ভেতর
[নেশা/শ্যামল সিংহ]    


সমালোচক প্রশ্ন রেখেছেন, ‘পোস্টমডার্ন কবিতা কি একেই বলে বর্ষীয়ান সম্পাদক (অসম্পাদক) মহাশয়?’ আমার প্রশ্ন কি এই বস্তু পোস্টমডার্ন কবিতা? পোস্টমডার্নিটি [...ইজম নয় কিন্তু], এটা তো একটা সময়ের, একটা বিশেষকালপর্বের নাম। ‘অসম্পাদনার কথা’ শীর্ষক ভূমিকায় বারীন ঘোষালও তাই-ই বলেছেন, ‘সময়ের নিরিখে অনুপম যথার্থ পোস্টমডার্ন, অন্তত কবিতার বিষয়ে’। ওঁর কবিতাকে তো পোস্টমডার্ন কবিতা ব’লে চিহ্নিত করেন নি বারীন ঘোষাল। ‘সময়ের নিরিখে’ অনুপমকে পোস্টমডার্ন বলেছেন। তাহলে ‘সময়ের নিরিখে’ পোস্টমডার্ন সময়ে বাস করা একজন কবিকে কি কবিতা লিখতে ব’সে ‘পোস্টমডার্ন কবিতা’র রূপ-রেখা-চিত্র দেখাবার দায় নিয়ে কবিতা লিখতে হবে? আর কবি সে দায় নিলেও কবিতা সে দায় নেবে কেন? এছাড়াও, ‘সময়ের নিরিখ’ ব্যাপারটা কি সবার জন্য একই রকম? একই প্রকার? এবং সেটা কি শুধুই একমুখে সামনের দিকে ও হরাইজেন্টালিই চলেছে? ‘সময়টা কারো একার নয়, সময়টা এর ওর তার, তোমার সময় দিয়ে তাই বৃথা চেষ্টা আমাকে মাপবার।’ পোস্টমডার্ন সময়ের কথা বলতে গিয়ে এক বাঙালি লেখককে দেখেছিলাম অসাধারণ এক উদাহরণ প্রয়োগ করতে। আধুনিক সময় ছিল একটা, যেখানে মানুষ সমগ্র বিশ্ব-চেতনা-কণাকে অনুভব করতো নিজের মধ্যে। বলতো, ‘‘আমাদের সব চেয়ে বড়ো প্রার্থনা এই যে, আবিরাবীর্ম এধি। হে আবি, তুমি আমার মধ্যে প্রকাশিত হওতুমি পরিপূর্ণ, তুমি আনন্দ। তোমার রূপই আনন্দরূপ। সেই আনন্দরূপ গাছের চ্যালা কাঠ নহে, তাহা গাছ।’’ অর্থাৎ যেখানে কোটি কোটি অসংখ্য সিলিকন কণা দিয়ে তৈরি হ’ত একটি আরশি। সেই আরশিটি হলাম ‘আমি’। নিজের মধ্যে এক সমগ্রকে খুঁজে পাওয়ার সময় সেটা। তারপর নীল রঙের এই গ্রহে মানুষ যা যা খেল দেখালো, এলো আরেক সময়, যখন সেই আরশিটি গেল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে। গাছ পড়লো কাটা। বন গেল হারিয়ে। পশু এলো বন থেকে বেরিয়ে। আরশির সব টুকরো মেঝেতে পড়লো সব ছড়িয়ে। কোনোটা হারিয়েও গেল। এখন, এই প্রত্যকেটা আলাদা টুকরোর আলাদা বাস্তবতা ও অস্তিত্ব আছে। প্রত্যেকের আছে আলাদা অবস্থান। এই প্রতিটা টুকরোই এসেছে ঐ ‘এক’ আরশি থেকে। আর সেই আরশি এসেছে কোটি কোটি সিলিকন কণা থেকে। এখন এই আরশির টুকরোগুলোর মধ্যে তাদের বাপ আরশির এবং ঠাকুর্দা ও পূর্বপুরুষ সিলিকন কণার বালুকাবেলার স্মৃতিটুকুই আছে, তাও ক্ষীণ। বরং তাদের প্রত্যেকের আজকের আলাদা অবস্থান, তাদের চেতনাকে পুনর্নির্মিত করছে। আর এখানেই আড়াল থেকে চুপ ক’রে এসে হাজির হন কার্ল মার্ক্স নামের ভদ্রলোক। এবং প্রকট হয়ে ওঠে তাদের এই টুকরো অস্তিত্ব। যেখানে সে নিজের মধ্যে সারা কসমসকে অনুভকে করছে না। বরং সারা কসমসেই দেখেছে নিজের আলাদা ‘আমি’গুলোকে ছড়িয়ে যেতে। তো, এই পরিস্থিতিতে বাস করা একজন কবি কোনো বিশেষ্য বা বিশেষণের আগে ‘একটা’ লিখে সেই একক টুকরোত্বকেই চিহ্নিত করবেন না তো কি করবেন? রবি ঠাকুরের বারবার খেলা, লীলা, আনন্দ, ছুটি লেখার মধ্যে, জীবনানন্দের বারবার ‘—’ চিহ্ন দেওয়ার মধ্যে ঠিক কি দর্শন কাজ করেছিল, আমরা কি আরেকবার ভেবে দেখতে পারি?  
একজন কবি তাঁর কাব্যজীবনে কতগুলি লাইন লেখেন? কত শ’? কত হাজার? সবগুলি লাইনই কি তাঁর কাব্য-নির্মাণের সর্বোচ্চ শক্তির পরিচয় বহন করে? নাকি সেটা দরকারি? যখন, কেউ কবির শুধুমাত্র শক্তিশালি কিংবা দুর্বল লাইনগুলিকেই তুলে আনেন খুঁজে খুঁজে, তখন বুঝতে হয়, সমালোচক কোনো একটি বিশেষ purpose solve করতে চাইছেন লেখাটি দিয়ে। এবং সেই purpose-টি সাহিত্যের রূপ-রসের এলাকায় পড়ে না।  
কবিতায় সিনেমার অনুষঙ্গ ব্যবহার নিয়ে সমালোচকের বক্তব্য অতি উদার। আমার বেশ কিছু কবিতায়, লেখায়, ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের অনুষঙ্গ সরাসরি ও পরোক্ষ। আমার সে লেখাগুলি পড়লে সমালোচক নিশ্চই বলবেন, কবিতা না ক’রে রাগ-সঙ্গীত করলেই তো হয়। বিষয়টা কবিতা, সিনেমা বা সঙ্গীতের নয়। বিষয়টা, আর্টের। আমি এভাবেই ভাবি। এদের কারুর মধ্যেই যৌথ-পরিবারের হাঁড়ি আলাদা করার বৈরী সম্পর্কে আমার আস্থা নেই। বিশেষ ক’রে আজকের সময়ে এসে বিভিন্ন শিল্প-মাধ্যমগুলির মধ্যে পারস্পরিক লেনদেনের প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে পারফর্মিং আর্ট-মিডিয়ামগুলির প্রকরণ-শৈলী কবিতায় প্রয়োগ করার। তাতে যদি কবিতা টেক্সট-ধর্মীতার দিকে যায়, যাক। তাতে যদি কবিতা কম্পোজিট আর্টের দিকে পা বাড়ায়, তো বাড়াক। এই অন্তর্গত লেনদেন ঘরানা ও বাহিরানায় কবিতাকেই পুষ্ট করবে। কবি কিভাবে করবেন সেই লেনদেন, সেটা তাঁর ব্যক্তি ও কবি-চেতনার ওপরেই নির্ভর করছে। উপনিষদে সত্যকাম-জাবালার কাহিনি প’ড়ে তার মধ্যে রবি ঠাকুর কবিতা খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে আপনার লেখাটি পড়েই আমার মনে হ’ল, সারাজীবনে উনি যতবার ওঁর সাহিত্যে উপনিষদের রেফারেন্স এনেছেন, এ’ যেন উপনিষদের আশ্রয় নিয়ে কবিতাকে বাঁচানো। সাহিত্য-চর্চা না ক’রে উপনিষদের টীকা লিখলেই তো পারতেন। রামপ্রসাদ সম্পর্কেও নিশ্চই আপনার একই মত হবে আশা করি। কালীর আশ্রয় নিয়ে নিজের গানকে বাঁচানো। আসলে, কবিতা এমনই একটি ব্যাপার, পৃথিবী ও ব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো কিছুর মধ্যেই তাকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তাদের কথাও এসে পড়তে পারে, লিখিত কবিতায়। রেফারেন্সিয়াল হ’ল বলেই তার জাত গেল যদি হয়, তাহলে বাঙলা কবিতার অনেক কবিতাকেই কবিতার রাজ্য থেকে ভাগাতে হবে। ‘শব্দ’ [Word] নিজেই একটি রেফারেন্সিয়াল ব্যাপার। যেহেতু যেকোনো ‘শব্দ’ কোনো একটি ঘটনা বা বস্তুকে রেফার ক’রে থাকে। আমার এই গদ্যেও প্রতিটি শব্দই কিছু-না-কিছুকে রেফার করছে।      
আপনার লেখার শুরুতে বলেছেন, ‘ছন্দ ভেঙে বেরিয়ে আসার লড়াইটাই হয়ে যাচ্ছে কবিতা’। যদি বলি এই লড়াইটা, [যদিও এটাকে কোনো ‘লড়াই’ ব’লে মনে করি না] শুরু করেছিলেন রবি ঠাকুর? আজ থেকে অন্তত ৮২ বছর আগে। ওঁর একটি গদ্যের একটি লাইন পড়া যাক। ‘‘মনে পড়ে, একবার শ্রীমান সত্যেন্দ্রকে বলেছিলুম, ‘ছন্দের রাজা তুমি, অ-ছন্দের শক্তিতে কাব্যের স্রোতকে তার বাঁধ ভেঙে প্রবাহিত করো দেখি।’’ তথাকথিত ছন্দে লেখা হোক না হোক, সমস্ত লেখারই নিজস্ব স্বাভাবিক ছন্দ আছে, এ’ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতপক্ষে, ছন্দ থেকে বেরিয়ে কিছুই হয় না। সাহিত্য তো নয়ই। আপনি বলছেন, ‘‘সিরিয়াস কবিতা-চর্চার নামে গুণিতক হারে বাড়ছে কবিতা পত্রিকা, কবি বলছেন, আহা, আর তিনটি হলে এবছর আমার একশো কবিতা প্রকাশ হয়ে যেত! ফর্ম ভাঙ্গার নামে গোবরের পায়েস খাওয়ানোও চলছে।’ নিশ্চই চলছে। নইলে বলছেন কেন। এ’ কথায় অসত্য নেই। কিন্তু, ‘সত্য’ বলতে একটি পূর্ণকে বুঝি। যার মধ্যে সমগ্রটাই ঢুকে থাকে। যেখানে, অস্তনির্জন দত্ত নামে এক কবি থাকেন, থাকেন সব্যসাচী সান্যাল নামে এক কবি, থাকেন নীলাব্জ চক্রবর্তী নামে একজন, সারা বছরে ৫টি পত্রিকাতেও হয়তো যাঁদের লেখা বেরোয় না। তাঁরা পাঠান না বলেই বেরোয় না। নিস্পৃহতার নির্জনতায় তারা থাকেন বলেই হয়তো বেরোয় না। তাহলে, দেখা যাচ্ছে, আছে, এসবও আছে। অথচ আপনার লেখায় সের’ম কোনো উল্লেখ নেই। বরং, এখানেও দেখা যাচ্ছে আপনি নেতিগুলোই তুলে আনছেন। এবং কোনো purpose solve-এর উদ্দেশ্য এখানেও প্রকট। আর, গুণিতক হারে চিটফাণ্ড, ম্যাসাজ পার্লার, কিংবা ফ্ল্যাট বাড়ার থেকে কবিতা পত্রিকা বাড়াটাকে আমি ভালো চোখেই দেখবো।   
চারটে প্যারাগ্রাফ আগে আমি বলেছিলাম, আরশির টুকরো হওয়ার কথা। সমগ্র থেকে শেকড় বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা। এক একজন স্রষ্টা এক এক অভিমুখে যাত্রা করেন। কেউ ওই টুকরো অস্তিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে, সেখান থেকেই শুরু করেন যা কিছু পেছনের, সেই সব কিছুকেই পেছনে ফেলে রেখে। কেউ কেউ ইতিহাস থেকে স্বীকরণ ক’রে, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যা কিছু আজ তার কাছে বেঁচে আছে, তার সম্পদ গোলায় তোলেন, এবং তাকে জারিত করেন নিজের সময়-পরিসর ও অভিজ্ঞতা মেধায়, এবং নিজের যাত্রাটি বজায় রাখেন। এই দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রাটি দ্বিমুখী। পেছনের দিকের যাত্রাটি অনেকাংশেই নিরীক্ষামূলক। আর সামনেরটা পরীক্ষার। এই শূন্যেই আমরা দেখেছি, অতীতের একদা ফেলে আসা বা বর্জিত উপাদানগুলিকে আজ আবার নতুন ভাবে কবিতায় ব্যবহার করতে। তাই কুমারসম্ভব, বা চর্যাপদের উল্লেখ মানেই তাকে ব্রাহ্মণ্যবাদিতার কবলে পড়া ব’লে কেউ মানলেও, আমি মানি না। কেননা, এই ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে প’ড়ে থাকা নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে এই পরিসরে একজন সচেতন মানুষের পক্ষে ইতিহাসের তলিয়ে যাওয়া পাতালে বেলচা চালানো অস্বাভাবিক নয়। এ’ আচরণ, এই কনফিউশন, অস্বাভাবিক নয় এক ‘টুকরো আরশি’র পক্ষে।
আমাদের আত্মার মতোই, চেতনার মতোই, কবিতার কোনো লাইন, সঙ্গীতের কোনো অংশের সুর— এসবের মধ্যেও একটা ঐক্য এবং সামগ্রিক-অস্তিত্ব থাকে। কোনো সঙ্গীত থেকে খাবলা মেরে একটা অংশের সুর তুলে এনে বলা যায় না, দ্যাখো, সুরকার এইখানে কিরকম। বলতে হ’লে সমগ্রটা নিয়েই বলতে হয়। তার ঐক্যটা নিয়ে বলতে হয়। একটি কবিতায় একটি যতিচিহ্ন পর্যন্ত বিরাট এবং কোনোক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সেখানে আপনি বিভিন্ন কবিতার বিভিন্ন জায়গা থেকে শব্দগুলো টুকরো টুকরো খাবলা মেরে তুলে এনে দেখাচ্ছেন, কোথায় বিরক্তিকর, কোথায় একঘেয়েমি, কোথায় সেকেলে, কোথায় মিথ, কোথায় রেফারেন্সিয়াল। ব্যাপারটা হাস্যকর নয়? এ’ যেন হাতে-পায়ে-মেঝেতে-জামায় কাদামাটি মেখে-ছড়িয়ে শিশুর আলপনা আঁকার খেলা।  আপনি বলেছেন, ‘সমস্যাটা কি এইচিন্তা-ভাবনায়-তত্ত্বে যে-অতনুকে আমরা চিনি সে কবিতার কাছে এসে কনফিউজড?আমি যদি বলি, কবিতায় আমি যে অতনুকে চিনি, চিন্তা-ভাবনায়-তত্ত্বের কাছে এসে সে কনফিউজড? অথবা, চিন্তা-ভাবনায়-তত্ত্বে যে-অতনুকে আপনারা চেনেন, কিংবা, কবিতায় আমি যে অতনুকে চিনি, সেটাই-বা সম্পূর্ণ ‘চেনা’ তাই-ই-বা বলি কি ক’রে? কথাটা শুনতে রূঢ় শোনালেও বলছি, এই লেখাটিতে আপনার কবিতাকে-দেখার-চোখে ছেলেমানুষির পিচুটি লেগে রয়েছে। মুছে আসুন। পূর্বাপর সংযোগ ও ঐক্যটিকে না বুঝে, না দেখিয়ে, কবিতায় কেন ‘কানু’, কেন ‘আখাতারি বেগম’, কেন ‘পুনরায়, কলস, তিনটে রঙে, তিনটে ঋতুর বিভাজন, ভ্রমর গুঞ্জন, হলুদ বাক্স, হলুদ বায়ু, সুরার করোটিপাত্র, কুহক জটিল’—  এমত প্রশ্নটা ছেলেমানুষই। আমি পড়াশোনায় বেশ ভালো ছাত্রই ছিলাম ইশকুল-কলেজ জীবনে। আবার মাধ্যমিকে টেস্টে অঙ্কে শূন্যও পেয়েছিলাম। তো এই শূন্যের ঘটনাটিকে উল্লেখ ক’রে কেউ যদি বলে বসেন, আমি ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলাম, তখন বুঝতে হয়, তাহলে আমার সমগ্রতাকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা কিংবা উদ্দেশ্য আছে বক্তার। যেমন, মহাভারতের যুদ্ধকে থামিয়ে রেখে কৃষ্ণের গীতার বচন কিংবা শরশয্যায় শুয়ে ভীষ্মের দীর্ঘ ভাষণ, নীতি বা তাত্বিকতার বিচারে যতই প্রয়োজনীয় হোক, মহাভারতের সামগ্রিক সাহিত্যগত বিচারে ভালো জিনিস নয়। কৃষ্ণ বা ভীষ্মের চরিত্রকে রূপ দেওয়ার জন্য সেখানে সাহিত্যের অন্য উপায় নেওয়া যেত নিশ্চই। কিন্তু আমি যদি মহাভারতের সমালোচনা করতে গিয়ে শুধু মাত্র এই খণ্ডটিকেই উল্লেখ ক’রে এর নেতিবাচক দিকটি, এর গণ্ডগোলটিকেই শুধু দেখাই, সেটা তাহলে আমার দেখার এবং বলার চূড়ান্ত অসম্পূর্ণতা। এবং কোনো উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। নদী থেকে এক-বাটি জল তুলে ল্যাবরেটরিতে এনে তার জীবাণু পরীক্ষা করা যেতেই পারে। সে পরীক্ষায় কোনো ভুল নেই। কিন্তু সেটা ঐটুকুই, তার বেশি নয়। ঐ জলের স্যাম্প্‌লের রিপোর্ট দেখে নদীকে বুঝতে যাওয়াটা, অন্ধের হাতি দেখা।  কেননা, নদীর পার্বত্যগতি থেকে নিম্নগতি, বিভিন্ন পর্যায়ে তার প্রবাহের চরিত্র, এবং উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত পার্শ্বভূমিতে তার বিস্তার, নিজের পেটের ভেতরে নিয়ে চলা বিবিধ প্রাণি, জীবজগৎ, ভেসে আসা মড়া, জড় ও পলি, তার জলে দিনের  কিংবা রাতের আলোর এবং অন্ধকারের রকমারি খেলা, ছোট-বড়ো বিবিধ নৌকার চলাফেরি ও নৌকার মাঝিদের গান ও হাঁকাহাঁকি ইত্যাদি ইত্যাদি ঐ এক-বাটি জলের স্যাম্প্‌লে থাকে না সমালোচক মহাশয়। নদীকে নিয়ে কথা বলতে হ’লে, গোটা নদীটাকে নিয়েই বলুন, এক-বাটি জলের নমুনায় ল্যাবরেটির কাজ মেটে, সাহিত্যের কিছু হয় না।     
রবি ঠাকুরের আরেকটা কোট দিয়ে আমার নিজের ছেলেমানুষিটি শেষ ক’রি এ’বেলা।   
‘‘...বিদ্যাপতি লিখছেন --
             যব      গোধূলিসময় বেলি
             ধনি     মন্দিরবাহির ভেলি,
             নব জলধরে বিজুরিরেহা দ্বন্দ্ব পসারি গেলি।
গোধূলিবেলায় পূজা শেষ করে বালিকা মন্দির থেকে বাহির হয়ে ঘরে ফেরে— আমাদের দেশে সংসার-ব্যাপারে এ ঘটনাই প্রত্যহ ঘটে। এ কবিতা কি শব্দরচনার দ্বারা তারই পুনরাবৃত্তি। জীবন-ব্যবহারে যেটা ঘটে, ব্যবহারের দায়িত্বমুক্ত ভাবে সেইটেকেই কল্পনায় উপভোগ করাই কি এই কবিতার লক্ষ্য। তা কখনোই স্বীকার করতে পারি নে। বস্তুত, মন্দির থেকে বালিকা বাহির হয়ে ঘরে চলেছে, এই বিষয়টি এই কবিতার প্রধান বস্তু নয়। এই বিষয়টিকে উপলক্ষমাত্র করে ছন্দে-বন্ধে বাক্য-বিন্যাসে উপমা-সংযোগে যে একটি সমগ্র বস্তু তৈরি হয়ে উঠছে সেইটেই হচ্ছে আসল জিনিস। সে জিনিসটি মূল বিষয়ের অতীত, তা অনির্বচনীয়।
ইংরেজ কবি কীট্‌স একটি গ্রীক পূজাপাত্রকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখেছেন। যে-শিল্পী সেই পাত্রকে রচনা করেছিল সে তো কেবলমাত্র একটি আধারকে রচনা করে নি। মন্দিরে অর্ঘ্য নিয়ে যাবার সুযোগ মাত্র ঘটাবার জন্যে এই পাত্রের সৃষ্টি নয়। অর্থাৎ মানুষের প্রয়োজনকে রূপ দেওয়া এর উদ্দেশ্য ছিল না। প্রয়োজনসাধন এর দ্বারা নিশ্চয়ই হয়েছিল, কিন্তু প্রয়োজনের মধ্যেই এ নিঃশেষ হয়নি। তার থেকে এ অনেক স্বতন্ত্র, অনেক বড়ো। গ্রীক শিল্পী সুষমাকে, পূর্ণতার একটি আদর্শকে, প্রত্যক্ষতা দান করেছে; ...সে কোনো সংবাদ দেয় নি, বহিঃসংসারের কোনো-কিছুর পুনরাবৃত্তি করে নি।...’’    |

Comments