আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর | আমেনা




                            মৃত্যু | আমেনা তাউসিরাত


[গৃহীত হয়েছে: I am Avijit - আমিই অভিজিৎ | Writer facebook page থেকে]

আজকাল রাতটা খুব বেশীই নামে এবাড়িতে। ভুতুড়ে রাতগুলোতে আমি জড়সড় একটা মোমবাতি হয়ে জ্বলতে থাকি। আমার শৈশব, গ্রাম, বাড়িঘর, উঠোন-বৃষ্টির রুপোর ফুল, বনের উন্মাতাল গন্ধ, আমার নাকে এসে ঝুলতে থাকে। আমি বসেই থাকি। মাঝে মাঝে ঢক ঢক করে পানি খাই। তবে গ্লাস খালি হলেও রুম ছাড়ি না। পাছে না কারও কষ্ট আমাকে আরও বেশি চেপে ধরে। অপাশের রুম গুলোতে ওরাও কি আমার মত ডুবে থাকে দূর পৃষ্ঠার গল্প খুলে?
ভাইয়া আমার চার বছরের বড়। বয়সটা আটাশ হবে হবে করছিল। দেখতে ছিমছাম সাধারণ। ফিল্ম বা TVC তে ঝলক দেখানোর মত চেহারা কিংবা উচ্চতা তার ছিল না তবে বুকে লাগতো তার হাসিটা। নাম অপু, যদিও রাশভারী একটা নামও ছিল এত শান্ত ছিল, একতাল ছায়া যেন, যেখানে দাঁড়ালেই শান্তি। ধর্ম মানেও তো শান্তি।  তবে শুধু atheist ছিল বলেই কি ধর্ম তাকে শত্রু জেনেছে?      
আদতে সে ছিল পাড়ার সুবোধ, সাধারণ ছেলেটাকেমিস্ট্রি ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়াশুনা ছিলকিন্তু কিভাবে জানি গ্রাফিক্সের প্রোটোকলে এসে পড়ল। সে নিয়েই কাজ করত। অফিস, বাসা, কফিশপ, ওইটুকুই ওর ব্যাপ্তি ছিল। ছুটির দিনে ক্যারামবোর্ডে দুপুর, সাথে আমি বিনীতা, নিশাত ,অমিয়, আপন। মাঝে মাঝে বাবাও ভিড়ে যেতভাইয়ার বানানো আইস কফি আর গল্পের তোড়ে আমরা কতবার কতদূর গিয়েছিলামআর ছুটির বিকেলে নিশাতের সাথে রিকশা ড্রাইভ এইটুকুই ওর দিন রাত্রি। নিশাত মানে আমার ভাবী, যাকে নিয়ে ভাইয়া একটা গল্প লিখেছিল- “জুতো প্রিয় মেয়ে”।
ভাইয়া কিন্তু খুব লিখত। রাতের পর রাত দিস্তা দিস্তা খসখসে লিখত রাজনীতির কথা, ধর্মপ্রীতি আর মোহমুক্তির কথা, সংস্কার আর স্বার্থের কথা, মগডালে যারা বসত – তাদের কথা যারা নিচে বসে পানি আর সার দিত, তাদের  কথা। তার লিখার পাশে বিরঙ্গনা খুব উদাস বসত। শহীদের মায়েরা সব কথা ভুলে যেত। স্যুটেড বুটেড রাজাকারেরা পাটি করা চুলে কি ভীষণ হাঁটত। মাটিতে রক্ত আর আকাশে শকুনের উড়াল দেখত আর মাঝখানে বসে সে লিখত। তার উপর সে তো atheist ছিল। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, হাইস্কুলে শেখা তার, তাই সেও  মাঝে মাঝে শান্তি প্রিয় কিছু হাওয়া দিত। সে হাওয়া কারও কারও টুপিতে গিয়ে লাগত। দণ্ডবিধির আইন বড় সেকেলে তাতে টালমাটাল টুপির human being(!) দের শান্তি দেবার মত কোন শাস্তি নেই, তাই তারা চাপাতি চর্চায় চৌকস হল। আর ভাইয়াটা  লিখতে লিখতে মরে গেল।
আর তাইত পথ লাগোয়া এই দোতলা বাড়িটা প্রতি রাতে মৃতের বাড়ি হয়ে যায়। আমাদের বাড়িটা। উত্তরার এগার নাম্বার সেক্টরের এই বাড়িটায় কিন্তু আমরা মাত্র চার বছর ধরে আছি। তার আগে আমাদের কোন নিজেদের বাড়ি ছিল না। বায়ান্ন হাজার তেপ্পান্ন গলির এই শহরের আঁতিপাঁতি গলিতে আমরা ভাড়া থাকতাম। সে যাক, এটা আমাদের বাড়ি। নিচের তলায় একটা কফিশপ, আধুনিক, অভিজাত, শীতল, ছোট্ট একটা কফিশপ। আমার মা আর বাবার পুরোটা সঞ্চয় আর স্বপ্ন এখানে আছে। দোতলায় আমরা থাকি। শোভন, সুন্দর, খুব সাধারন একটা বাসায়  
এখানে কয়েকটা রুমের একটা আমার। ঘিয়ে রঙ চাদরটার উপর কিছু নিউজপেপার মেলে আমি বসে আছিযেখানে ভাইয়ার ভয়ানক মৃত্যু দৃশ্যগুলো সেঁটে দেয়া। ভাইয়াটা রক্তের অংশ হয়ে ক্রমাগত নৃশংস ব্যথা ঢালতে থাকে আমার ভেতরে। সেই ছুরি, সেই চাপাতি, সেই...। মানতে পারি না। তবুও প্রতি রাতে একা একা, এগুলো নিয়ে বসে থাকি
তোর কুঞ্চন আমার জন্ম থেকে চেনা। তাই খুঁজতে থাকি ব্যথার ভাষা, শরীর কিংবা মনের। যা কোনদিনও আর জানা হবে না। মাথা, মুখ, গলার  ভেতর দিয়ে.....উফ... 
তুই কি রক্তের স্বভাব জানিস? সুতোতে টান পড়লে তিরতিরিয়ে দুঃখ বাজে, বুকের গহীনে। তাই দেখে না কেউ। ইতিহাস বলে, আমরা চারজন ভাইবোন। যুদ্ধে, ভালবাসায়, ছায়ায় ছায়ায় নির্ভরতা। কিন্তু তোর জন্য আমরা কিছুই করতে পারলাম না।
নিশাতের জন্যও ভীষণ কষ্ট হয়। গেল বছরের ফেব্রুয়ারীতে বিয়ে হয়েছিল তাদের। বসন্তে বিয়ে, কুহু শিল্পের দিনে দুজনের রাতগুলো দীর্ঘ না হ্রস্ব ছিল? খুব ভালবাসত তারা একজন আরেকজনকেতাদের পরিচয়, প্রেম, সবটাই গল্পের মত। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ভাইয়া ক্যাফেতে থাকতকখনো মায়ের সাথে গল্প করত, বই পড়ত, cold brew, doppio বা ristretto কফি বানাত, কখনো সার্ভও করত

cafe imagination”-এ কিছু রেগুলার কাস্টমার আছে, যারা প্রায়ই আসে, বসে আর চুপচাপ কাজ করে যায় ল্যাপটপ কিংবা ট্যাবে আমাদের কফিশপের ভেতরটা দারুণ তো তাই। ক্রিম ওয়াল আর লেমন কালার ব্লাইন্ডের সাথে এন্টিক ডিজাইনের ফার্নিচারে একটা সজীব ভাব, আর সাথে wi-fi তো নিশাতও এমন কেউ ছিল, একাই  আসত। চকলেট কফি আর পেস্ট্রি নিয়ে নিজের মত কাজ করতনিশাত দেখতে যেমন ধারাল সুন্দর, তেমনি উচ্চারণ। তবে ভাইয়া বলত, ওর জুতার কালেকশনই প্রথম ভাবিয়েছিল তাকে তারপর সাহিত্য, সমাজ, সংঘাত, স্বার্থ, সাম্রাজ্যবাদ থেকে একদিন ফেয়ারি টেইল   
নিশাত কি শুয়ে পড়েছে? দলা পাকানো ব্যথার মধ্যে কি শুয়ে থাকা যায়? জঠরে যে গুটিসুটি জড়িয়ে আছে সেও কি বিছানার শূন্যতা টের পায়?
খুব আকস্মিক একটা দুপুর ছিল কাল। যেদিন ভাইয়াকে ওরা মেরে ফেললো, সেদিন থেকেই নিশাত খুব এলোমেলো হয়ে আছে কথা হারানো, হুহু কান্নার একটা সাদা পরী হয়ে বসে থাকে, কান্নার জল আছে কিন্তু শব্দ নেই। দেখলেই বুকে দলা পাকায় কান্না, তাই আমি ও মুখো হই না। মা-ই থাকে ওর সাথে দিনের বেলা আর আপন। তো কাল আমি অনেকদিন পর রাঁধতে গিয়েছিলাম, টুকটাক কিছু। ভাইয়া নেই সতেরদিন আজ, তবু এ বাড়িতে আড্ডা নেই, হল্লা নেই, ডাইনিং এ মুখরতা নেই, রান্নাঘরে বাহারি ব্যঞ্জন নেই। তাই নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে আমি রান্না চাপিয়েছিলাম। হঠাৎ আপন বলল, নিশাত কেমন যেন করছেতারপর হুড়োহুড়ি পরে গেল, একটু থিত হবার মা হাসপাতাল নিয়ে গেল। তারপরই প্রথম জানা, নিশাত প্রেগন্যান্ট, ভাইয়ার প্রিয় এই স্বদেশে আমাদের ছজনের সাথে সে তাঁর সন্তানও রেখে গেছে। যাকে সে কখনো ছোঁবে না, বুকে লেপটে নিয়ে ঘুমুবে না।     
এত সুখ তবু এই আনন্দটা ভাগ করার সামর্থ্য, স্পর্ধা বা উপায় জানা নেই আমাদের। শুধু যে যার মত কান্না লুকানোর কসরত।
বিছানায় আমার অস্থির লাগে। লাইট বন্ধ করে এসে জানালায় দাঁড়াই। রাতের জানালায় আলোদের হৈচৈ নেই। বাতাসের খুঁজে হাত বাড়াই। আমার ভীষণ বাতাস দরকার আজ
ভাইয়া মারা যাবার পর বাবা একদম মিইয়ে গেছে বাবা আর খবর খুঁজে পেপার পড়েন না ঘণ্টা গুণে। আসলে আমাদের বাসায় এখন একটা পেপারও রাখা হয় না। কোন খবরইতো আর সুদিন আনবে না 
মা খুবই গুছানো, কষ্ট তাঁর গুছিয়ে রাখা। কাউকে দেখতে দেন না। স্বাভাবিক হাঁটেন, কাজ করেন, ক্যাফেতে যান, যে café র প্রতিটা ছোঁয়ায় তার অপু আছেতবে মা আমাদের একটা ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। আমরা আর লিখতে পারব না। চেতনা, বিশ্বাস, প্রতিবাদ, এমন কি গল্প। আমরা আর কিছুই লিখতে পারব না। মার সোজা কথা- “লেখক বা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড চাই নাআমি মৃত নয়, জীবিত সন্তান চাই। ছাপোষা জীবনে বেঁচে থাকাটাই সব।”
মা রাগ বা কষ্ট থেকে এসব বলছে, ভুল বলছে। ছাপোষা জীবনেও বাক্‌-স্বাধীনতা আছে। সংবিধান আমাকে সেই স্বাধীনতা দিয়েছে। তবু আমরা কিচ্ছু বলি না। শুধু তের বছরের পাপন বলে বসে,
-মা আমাদেরও তো গল্প আছে?
-কোন গল্প নেই। আর অমিয় তোমাকে বলছি, ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আর কাজ নেই। বাইরে যেতে পার কি না দেখ। মেধা বেঁচে খাও। বিনীতা চাকরি খুজঁতে হবে না আর। সবাইকে বলছি, নিশাত তোমাকেও। আমি সব বিক্রি করে টাকা দেব। সবাই চলে যাও।
অমিয় বিস্ময়ে কথা পায় না। অস্ফুট শব্দ আসে,
-মা...তুমি বলছ? তুমি তো আগে আমাকে ট্রাইও করতে দিতে না। তুমিও যাবে?
-না। আমি অপুর কাছে থাকব।
মা আর কি বলতে পারত? তার ছেলেতো ইয়াবা সম্রাট ছিল না? ড্রাগস ছড়িয়ে সমাজের ফুসফুসে ফুটো ধরায়নি। চোলাইমদের বাণিজ্য ছিল না তার। ভয় আর জীবন ভর্তি বাসে বোমা ছুড়েনি কোনদিন। রেপিস্ট ছিল না সে। তবু শুধু লিখত বলেই তাকে মরতে হল। এই মৃত্যুর ঘা নিয়ে মা বেঁচে থাকবে। অপেক্ষায় বসবে বিচারের।
সত্যি তারা লিখবে না। হয়তো নিজেদের, ঠিক নিজেদের দেশেও আর থাকবে না। ভাইয়ার সন্তান যেখানে বড় হবে সেখানে, বাংলাদেশের বোশেখ, বসন্ত বা বইমেলা থাকবে না। তার তো বাবাও থাকবে না। বিথর বিথর ব্যথা আর হুহু গল্প ছাড়া আমাদের আর কিছুই থাকবে না।



আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments

  1. This is my first time go to see at here and i am in fact pleassant to read all at one place. gmail login

    ReplyDelete

Post a Comment