আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর | অভীক




                ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায় | অভীক দত্ত


[চিত্রণ: ভেসিলি গ্রিগরেভিচ পেরভ, রাশিয়া]

বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী। তার সাথে তাঁর সব থেকে প্রিয় মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। বিহারীলাল চক্রবর্তী বেশ নামকরা কবি। এলাকার মান্যিগন্যি লোক। তা যাই হোক পণ টণ দিয়ে বিয়ে তো হল। এমনকী শরৎচন্দ্র যখন বিলেতে গেলেন তখন তার খরচ পর্যন্ত তাঁকে দিতে হয়েছে। তারা জোড়াসাঁকোতে এসে তাঁর বাড়িতে থাকা শুরু করলে মাধুরীলতার সাথে তার ছোট বোন মীরার সম্পর্কের অবনতি ঘটায় তারা সে বাড়ি ত্যাগ করে অন্যত্র ছোট বাড়ি ভাড়া করে থাকে। মাধুরীলতা ভাবলেন তার বাবা তাঁর ছোট মেয়ের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। এর ফলে যা হয়। তবে এতেই রবীন্দ্রনাথের কষ্ট কমল না। বড় মেয়ে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হলেন। তিনি যখন মেয়েকে সকালবেলা দেখতে যেতেন এই জামাই যার সম্পর্কে তিনি জগদীশচন্দ্র বসুকে বলেছেন যে তাঁর মনের মত হয়েছে, তাঁর সামনে দুপা টেবিলের ওপর তুলে সিগারেট টেনে যেত।
এই যন্ত্রণা থেকে রবীন্দ্রনাথ মুক্তি পেলেন মেয়ে মারা যাবার পর। নিজের সন্তানদের কাছ থেকে এরকম ব্যথা পাবার ক্ষেত্রে একজন সাধারন বাবা আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে খুব বেশি তফাৎ ছিল না।

পেটে ব্যথা- ১
স্কুলের নাম শুনলেই ছোটবেলায় আমার বেজায় পেটে ব্যথা হত। স্কুলে কিছুতেই যেতে চাইতাম না। বাবা মা জোর করে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যেত। ছোটবেলার ব্যামো না, বড়বেলা অবধি এই ব্যামো ছিল। তারপর যখন অফিসে এলাম বুঝতে পারলাম মাপা রেশনের মত সি এল, মেডিক্যালের ধাক্কায় পেটে ব্যথা সত্যি সত্যি করলেও অফিসে আসতে হবে। এখানে কোন রেনি ডে নেই, কোন ছুটির দিন নেই। ব্যথা ট্যাথা গুলি তাই সেই ছোটবেলাতেই পড়ে রয়ে গেল। 


স্কুল ব্যথা-২
আমার মনে আছে ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। ক্লাসে নীলাভ বলে একটা ছেলে ছিল। ও একটা বল নিয়ে আসত, সেই বল নিয়ে ফুটবল বারের ওপর দিয়ে আমার ক্যাচ ক্যাচ খেলতাম। নীলাভ একদিন হঠাৎ পরিষ্কার বলে দিল আমি খেললে ও বল দেবে না। কেন বলল কি কারণে বলল আমি জানি না। কিন্তু বলল। আমি ভেবেছিলাম আমার সাথে যারা থাকবে তারা হয়ত প্রতিবাদ করবে যে অভীক না খেললে আমরাও খেলব না। কিন্তু না, কেউ কিছু বলল না। ওরা আমাকে না নিয়েই খেলা শুরু করল। সেদিন সম্ভবত প্রথম বুঝেছিলাম পাশে অনেকে থাকলেও সাথে কাউকেই পাওয়া যায় না।
প্রেম ব্যথা-৩
কলেজে এক ছেলে ছিল উৎপল বলে। খুব উজ্জ্বল ছেলে। পড়াশুনায় ভাল। জয়েন্টে ভাল র‍্যাঙ্ক করে কলেজে এসেছে। হঠাৎ ঝুপ করেই এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল অন্য ডিপার্টমেন্টের। একসাথে ঘোরা ইত্যাদি তো ছিলই। একদিন হোস্টেলের ছেলেরা আবিস্কার করল উৎপল রাতে নিজের শিরা কাটতে গেছিল। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল মেয়েটির একটি বয়ফ্রেন্ড আগে থেকেই ছিল। তাকে কলেজের টেম্পোরারি বয়ফ্রেন্ড হিসাবে ব্যবহার করত। আসল বয়ফ্রেন্ডটি জানতে পারার পরে বেধড়ক মার খায়। ছেলেটাকে এমন মার মেরেছিল যে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।

মাথা ব্যথা-৪
ডাক্তার বলে দুম দাম করে ওষুধ খাবেন না। দেখিয়ে নিয়ে খাবেন। কিন্তু দেখিয়ে নিয়ে খেতে হলে যে চাপ আছে, দোকান থেকে একটা স্যারিডন কিনে খেলে সে চাপ অনেক কমে যায়।

গলা ব্যথা -৫
মান্না দে-কে পোড়াতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা গাড়িতে শুধু দেহটা। একা একা চলে গেল পুড়তে। গলার কাছটা কেমন দলা পাকিয়ে আসে। এ ব্যথার উপশম আর কোনদিন হবে না।

মনে ব্যথা-৬
একের পর এক ম্যাচ হেরে গেলেন। নাইট রাইডারসকে হারানো হল না। আই পি এলে চুড়ান্ত ব্যর্থ। ধারণা ছিল কলকাতা পাশে থাকবে তাও থাকল না। দাদার এই ব্যথা এখনও তাড়া করে বেড়ায়। কে যেন বলেছিল “once a gangulian always a gangulian”. ঠিকই বলেছিল।

ব্যথা-৭
বাবার প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ক’দিন ধরে রোগা হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার বলে যাচ্ছিল ডায়াবেটিস। শেষমেষ জন্ডিস হবার পরে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে রোগটা ধরা যখন পড়ল তখন শেষ স্টেজ। আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছি না। কি বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। মাও সব বুঝছে, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। তিনমাস পরে যখন বাড়িতে বাবা মারা গেল, আমার মার কারও চোখেই জল নেই। ব্যথা শুকিয়ে গেছে। এরকম কেন হল জানি না। কান্নাও আসছে না। ব্যথা যখন রেকারিং হয়ে যায় তখন মনে হয় এরকমই হয়। ধীরে ধীরে কষ্টটাকেও শুষে নিয়ে চলে যায়।

একা একা বসে বার বার বাবার অসহায় মুখটা মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে, প্রতিবার ডাক্তার দেখিয়ে এসে বলত “ডাক্তার মনে হয় আমার রোগটা বুঝতে পারছে না বুঝলি”

রবীন্দ্রনাথ দিয়ে লেখা শুরু করলাম কেন? কি করব! এই ব্যথা জিনিসটা কি আর রবীন্দ্রনাথ কিংবা অভীক দত্ত দেখে আসে!   



আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments