আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর | সোমঋতা




                               ব্যথা | সোমঋতা ভট্টাচার্য

[চিত্রণ: রামেশ্বর ব্রুটা, ভারত]

ব্যথা?
কোথায়? ঠিক কোন্‌ জায়গাটায়?
রক্ত পড়ছে?
ছড়ে গিয়ে নুন-ছাল উঠে গেল, না দড়াম আছাড় খেয়ে হাঁটুর উপরে হিজিবিজি কাটাকুটি?
খুব জোর তীক্ষ্ণ কোনও ব্যথার কথা….
একবার সেই পাঁচিল ডিঙিয়ে চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে গিয়েছিল ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা ভেঙে। তখন বোধ হয় ক্লাস টু। মা অনেক বার বারণ করেছে। কানে নিইনি কথা। কাজেই, এ বার অশেষ দুঃখ আছে কপালে। মাস চারেকের বড় মামাতো ভাই ভয়ার্ত মুখে রুমাল ভিজিয়ে বারবার বাঁধছিল আঙুলটায়। কিন্তু সে কী বেদম টনটনে ব্যথা রে ভাই! সেই পা নিয়েই লেক টাউন থেকে কাঁকুড়গাছি। এক মাসির বাড়ি থেকে আর এক মাসির বাড়ি- বাস বদলে, খানিক হেঁটে
-   খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেন?
-   নতুন জুতোয় ফোস্‌কা পড়ল যে! একটা ব্যান্ড-এইড কেনো না!
-   দেখি কোথায়? কড়ে আঙুল তো?
-   না, এই যে বুড়ো আঙুল।
-   বুড়ো আঙুলে ফোস্‌কা!
ব্যস্‌! আর যায় কোথায়! ততক্ষণে আঙুল ফুলে শক্ত হয়ে নীলবর্ণ। থাকো দু’মাস লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে। নাচের ফাংশান টাংশান সব ভোগে!
ও এমন কিছু নয়। ওর’ম তো কতই হয়! সেই সে বার দিল্লিতে এক জন আত্মীয়ার নতুন পার্লারে চুল কাটাতে গিয়ে এক সুন্দরী নাপতেনী দিল গালটা কুচ করে কেটে। তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর বোধ হয়। গাল দিয়ে টুসটুস করে রক্ত গড়াচ্ছে। নাপতেনীর চোখ দিয়ে জল (খুব সম্ভবত ট্রেনিং পিরিয়ড চলছিল তার)। জ্বালা করছিল গালটায়, কিন্তু অত লোকজনের সামনে কান্নাকাটির আরও জ্বালা। কি দরকার ভাই! তার পরে সেই আত্মীয়া আবার ক্ষতিপূরণ হিসেবে দু’বাটি লজেন্স দিল। ততক্ষণে তো মেজাজটা দিব্যি শরিফ।
আসলে ব্যাপারটা কী? ওই বয়সটায় চেহারাটা ছোট ছোট থাকে, আর মনটা হেব্বি দরিয়া থাকে তো! কাজেই মোটরসাইকেলের ধাক্কা, পড়ে গিয়ে এ দিক সে দিক কেটে যাওয়া- ও সব তেমন গায়ে লাগে নাএমনকী, সত্যি বলছি- অগুনতি ইস্কুল বদল, শহর বদল, বন্ধু বদল সব সয়ে যায়... সঅঅঅঅব।
কিন্তু ঠাম্মু!
আমি তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি। প্রথম বছর। অফিস থেকে সস্তায় বেশ কিছু পুজোসংখ্যা পেলাম। লাফাতে লাফাতে বাড়ি ঢুকেই সব বই ফেললাম ঠাম্মুর কোলে। নতুন গল্প নিয়ে আলোচনা করার একদম ঠিকঠাক লোক। অনবদ্য শ্রোতা, যেটা খুব দরকারি আমার কাছে।
-   কী রে এগুলো দিদিভাই? শারদীয়া বেরিয়ে গেল নাকি?
-   হ্যাঁ, এই দ্যাখো না! তোমার জন্য সব এনেছি। দাখো দ্যাখো!
ম্লান হেসে ঠাম্মু হাত বুলোচ্ছে একটার মলাটের উপরে। স্নেহ ছুঁইয়ে দিচ্ছে অক্ষরগুলোর উপরে। চোখটা তো সঙ্গ দেয় না আর। উৎসাহের আতিশয্যে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম আমি।
ক্লাস ওয়ানে বিষবৃক্ষ নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছিলাম। ঠাম্মুর বঙ্কিম রচনাবলী। তার পরে দেবী চৌধুরানীতে গিয়ে সারা দিন দু’জনে মিলে আওড়াতাম,
‘‘…..ও পি, ও পিপি, ও প্রফুল্ল, ও পোড়ারমুখী!’’
অদ্ভুত অ্যাসেন্ডিং অর্ডার না!
আমি আর‌ আমার তিন জ্যাড়তুতো দাদা- বইয়ে বইয়ে, বাংলা অক্ষরে ভরে গিয়েছিল মনের সব ক’টা কোণাপ্রায় পুরোটাই ওই ঠাম্মুর জন্যই। কী জ্বলজ্বলে, রঙিন আলো ঠিকরোনো ছোটবেলা! মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত, রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা, তুঙ্গভদ্রার তীরে, তুমি সন্ধ্যার মেঘ, গর্ভধারিণী, প্রথম প্রতিশ্রুতি- সব ঘিরে রেখেছে যে!
যা খুশি, তাই বকছি? ব্যথা কোথায়, এ তো সমারোহ!
আসলে তাজা ব্যথাটা তো লুকোনো ছিল সদাহাস্যময় মুখের ধীরে ধীরে একেবারে জ্যোতি হারিয়ে যাওয়া ওই চোখ দু’টোর কোন্‌ গহীনে। অস্বস্তিটা ছিল বোধ হয় একেবারে অকেজো হয়ে যাওয়া শ্রবণেন্দ্রিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে অপ্রতিভ না শুনতে পাওয়াটাকে যখন ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করত অনাবিল হাসি, ব্যথাটা ঘুরত তখন।
ঘুরত ব্যথাটা, ঘুরত…. শিরদাঁড়া বেয়ে উঠত। বুঝত না। কেউ বুঝত কি?
মুশকিল বোঝা। মুক্তো-অক্ষর, চিরকেলে চেনা বন্ধু শব্দগুলো যখন ঝাপসা হতে হতে হারিয়ে যায় এক্কেবারে, শুধু নতুন ছাপা পাতাগুলোর গন্ধ আনচান করে দেয় মনটাকে, তখন যখন এক কথা বারবার বলতে ইচ্ছে করে, আর ঝলমলে নাতি-নাতনিগুলো ধমকে থামিয়ে দেয়…..
ভালই বাসে ওরা। ভালই তো। কিন্তু তবু….
তখন ছিল তা-ও যেমন-তেমন। এখন একলা বিলেত-যাপনের অকাজের দুপুরগুলো, ঘুঘু-ডাকা ধূসর রোদের দুপুরগুলো সেই সরুপাড় সাদা শাড়ির হঠাৎ কালো বা একদম সাদা বা অন্য কোনও একরঙে বদলে যাওয়া দুপুরগুলোকে ছুঁতে চায় যেন। মনে হয়, আদর বুলিয়ে দিই। ধরে থাকি আঁকড়ে, যতটা পারি। গল্পে গল্পে ভরিয়ে দিই বাকিটা, যতটা ছিল পড়ে
পথ নেই আর। উপায় নেই তো কোনও! শুধু শেষ ক’দিনের বিড়বিড়গুলো কানে বাজে। যখন বিদায় নিয়েছে আরও কিছু ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব
-   ‘‘ও মা! দেখুন, রিয়া এসেছে। রিয়া!’’
-   (নিস্পৃহ উত্তর) ‘‘কই রিয়া। রিয়া তো আসেই না’’
---
 | |


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments