আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর | (অনির্বাণ)




                    ব্যথাজল | অনির্বাণ চক্রবর্তী (অনির্বাণ)

খুব জলের দিনে দাদা মারা গেল। সে ভরা বাদর। মৃত্যু ছাড়া আর কিই বা হতে পারতো সেদিন। কপালে চন্দন-ফোঁটা। মাথার কাছে বসে থাকা বৌদি বড় আদরে সাজিয়ে দিয়েছে সেই মৃত্যুদৃশ্য। বড় পিসি উঠোনের সিঁড়িতে বসে ঠেস দিয়েছে দেয়ালে। ইতিউতি ভেঙে পড়েছে গ্রামের লোক। পায়ের কাছে বসে আছে আদরের মেনী বিড়াল। আগের রাতের আকাশের মতোই থম মেরে আছে সবাই। খুব কি উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠা উচিত এখন? ছোটদার কচি মেয়েটাও তাই কান্না ভুলে জল দেখছে বাইরে।     
আমাদের দেশের বাড়ি জলের ধারে। দালানের সীমানায় সরু দরজা। বেরোলেই সিঁড়ি নেমে যায় ঘাটে। সবুজ জলের মুখ কালো হয় শুধু বৃষ্টির দিন। যেসব গাছেরা জলের দিকেতে মুখ চাওয়া-চায়ি করে, তাদের প্রতিটি পাতা সেদিন অসময়ে ভরে যায় পাখিদের ভিড়ে। গাছেদের সেদিন বড় সুখী মনে হয় আমার। এক অদম্য যৌন তৃষ্ণার পরে যেন অপার বিশ্রাম। মৃত্যুর মতোই শূন্য সুন্দর তা।   
মৃত্যু ছাড়া সত্যিই আর কিছু হতে পারতো না সেদিন। তবে হ্যাঁ, বড় জল হয়েছিল।
জলের অনুষঙ্গে আমার নানা কথা মনে পড়ে। নিম্নগামী জলের ডাকে ভেসে আসে কথার শরীর। সময়ের মাটি দুমড়েমুচড়ে বদলে নেয় বসত। সরে সরে যায়। কোনটা আগে ঘটেছিল, কোনটা বা ঘটে নি আদৌ? ঘটাই কি সত্য? পুকুরের ঘাটে বসে মনে পড়ে নেমে যাওয়াই এই সিঁড়ির নিয়ম। কেবল স্নানের শেষে বৌদির ভেজা চুল বেয়ে উঠে আসে মাতৃ-ঘ্রাণ। ছোটবেলায় ঠাম্মাকে আল্পনায় আঁকতে দেখা লক্ষ্মীর পা একে একে পড়তে থাকে উপরের সিঁড়িগুলোতে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে বড় পিসি। বৌদি স্নান সেরে ঘরে গেলে জলে নামবে। ঢেউ উঠবে ফের। গোল তরঙ্গ ক্রমে সরে যেতে থাকবে ওপারের রাস্তার দিকে। সেই পাড়ে বড় ছোট হয়ে থাকা ব্যাঙ, ফড়িঙেরা খবর পাবে পুকুরে নতুন অতিথি নামার। জলে জলে খবর চলে যাবে। এক ঢেউ থেকে আরেক ঢেউ। সিঁড়ির উপরের ধাপে বসে আমার খুব বড় মনে হবে সবকিছুকে। দু-একটা জল ছিটকোবে গায়ে। কখন যেন গায়ে গামছা জড়িয়ে বেরিয়ে আসবে দাদা। আমার পুকুরে নামার সময় হয়ে এল তবে। দাদা সাঁতার কাটে। আমাকে শেখায়। জল কত অনায়াসে বন্ধুত্ব করে দাদার শরীরে। দেখাদেখি আমিও চেষ্টা করি। উপরের ময়লার জল দুহাতে সরিয়ে সরিয়ে তারপর ভেসে থাকা। হাতের নাগাল থেকে সিঁড়ি সরে যায় ক্রমশ। জলের ভিতরে এক অদ্ভুত শব্দ গেঁথে থাকে। মাথা ডুবে যায়। এই অদ্ভুত শব্দের দেশে চিরতরে চলে যেতে চায় শরীর। হাত ধরে ফেলে দাদা। বলে, মরবি না রে, ভয় নেই। তারপর পিঠে গামছা ঘষতে ঘষতে গান গায়। ‘কতবার আঁখি চলে গেল জলে/পাছে কানু পড়ে ছায়া’। কাল কীর্তন। দাদা চলে যাবে কাটোয়া। আরেক জলের দেশ। আমাদের বাড়ির পাশেই যে নদী, তা ধরে চলতে চলতেই তো কাটোয়া পৌঁছে যাওয়া যায়। তবে এত ঘুরপথে যায় কেন মানুষ? আজ এ বাড়িতে আমারও শেষ দিন। কাল ফের শহর। যে শহরে ফিরতে একটুও ভালো লাগে না আমার। অথচ যেখানে আমার মা থাকে, বন্ধুরা থাকে। স্নান সেরে ওঠার আগে দাদা বলে জলের সঙ্গে সময় কাটালে জলও বন্ধু হয়ে যায়। এরপর শুধু জলের সঙ্গে থাকা। ডুবে যাওয়ার আর ভয় থাকে না তখন।
মৃত্যুর সঙ্গে সেই সমস্ত বন্ধুজল-কেই নিয়ে কি যাবে দাদা? তারা কোথায়ই বা যাবে? সম্পর্ক কতখানি যেতে পারে মানুষের সাথে? তবুও মৃত্যুর দিন বড় বেশি জল। এই জল দেখে সবারই দুশ্চিন্তা হয়। যাকে নিয়ে সমস্ত জীবন কাটাবে কল্পনা করে মানুষ, মৃত্যুর পর তাকেই কত দ্রুত বিদায়ের ঝোঁক। তারপর রাত নামে। জল আরও গতি পায়। দাদার শরীর নিয়ে রাস্তায় নামে গুটিকয় লোক। পাশের গ্রামে শ্মশান। পায়ে হাঁটা পথ ধরে যেতে যেতে শেষবার সমস্ত ছুঁয়ে নেয় দাদার অচেতন শরীর। হাটের সেই বেদী, স্কুলের মাঠ। সেইবারে যাত্রায় দাদা বিবেকের গান গেয়েছিল। মুখে মুখে স্মৃতি ফিরে এলে হরিনাম করতে করতে চোখ মোছে তাপস। এই সমস্ত জল মিশে ভিজে গেছে পথ। দাদার শেষ যাওয়াতেও কত বন্ধুত্ব বুনে নেয় জল। শ্মশানের মুখে একটিবার মাটিতে নেমে আসে দাদার দেহভার। সবটুকু চলে যাওয়ার আগে যেন যাচাই করে নেওয়া শেষবারের মতো – পিছুটান নেই কোনও? একবারও ফিরে দেখবে না? এরপর আগুন টেনে নেবে দাদাকে। দূরে পড়ে থাকবে দাদার গান শেখাতে আসা, বিনু কাকুদের ঘর, বাড়ির দালান, বউদির স্নানভেজা সিঁড়ি। দাদার রেখে যাওয়া সমস্ত গান অনুষঙ্গ-অধিকারে পাক খাবে হাওয়ায় মাটিতে। দাদা থাকবে না। অথচ কি ভীষণ থেকে যাবে অপেক্ষাশরীর। জলের আকাঙ্খাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকবে পুকুরের ঘাটে। সেই ধাক্কায় কত খবর চালাচালি হবে এপার-ওপারে। অপেক্ষা বানভাসী হবে।
সেই জলের দিন নদীও বানভাসী হতে চায় যেন। দাহ সময় নেয়। এতটা পথ এসে সবারই ক্লান্ত লাগে খানিক। শ্মশানের উজ্জ্বল পোড়াটুকু ছাড়া আর সমস্তই যেন বড় বেশি কান্নার মতো। অথচ পাশের নদীতে বড় ঢেউ ভাঙে। কেন জানি না মনে হয় এবারে ফিরতে হবে। একা নেমে আসি পথে। নদীর পাড় বরাবর উঁচু রাস্তার পাশে গাছগুলো কী ভীষণ চুপ। এক চিরকালীন অপেক্ষার ভিতর নেমে আসি যেন। বড় বেশি অন্ধকার মনে হয় বিদ্যুৎ খেলে গেলে। হাঁটতে থাকি। আমার পায়ের নীচে মাটি। অথচ মনে হয় এক অনন্ত জলের কাছে নেমে চলেছি ক্রমশ। দু পাশে পাড় ভাঙছে অশান্ত নদী। ভেঙেই চলেছে। আমি দেখি কত অসহায়ভাবে কেঁদে উঠছে মাটি, তারপর তলিয়ে যাচ্ছে নদীর ভিতরে। অতঃপর পথের সর্বস্ব জুড়ে ভরে উঠছে জল। আমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় নি কখনও। তাই ভয় করে। একাকার হতে হতেও ভয় করে। সেই অদ্ভুত এক শব্দের দেশ ঘিরে ধরতে থাকে। আমি শুনতে পাই সেইসব শব্দের ভিতরে দুমড়ে চলেছে জলের শরীর। বড় অস্থিরভাবে তারা বলে চলেছে অনন্ত চাহিদার কথা। সেই শব্দের বৃত্তে চিরতরে তলিয়ে যেতে যেতে টের পাই দাহ শেষ হয়ে এল। শেষ। এইবারে হাত রাখো দাদা। ওদের শোক তোমার স্পর্শ পাক। নতুন করে পাক।
তোমার ভস্মশেষ শরীরে নিলেই শান্ত হবে এ জল।
---

[Yugant by Aparna Sen]
 


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments