সি রি য়া স ঋ সা র্চ | শ্রেয়সী




                  ব্যথা নেই আর কোনো | শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

(১)
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রকাশ্য খুনটির সঙ্গে যুক্ত ছিলো অসহনীয় ব্যথার কাহিনী। যীশুকে যেভাবে মারা হলো আর পাশবিকভাবে অত্যাচার করা হলো তার শারীরিক উৎপীড়নের মাত্রা তীব্র যন্ত্রণাদায়ক একথা সত্য। অন্যদিকে একেবারে আমাদের দেশের কাব্যে! সেখানে কি হচ্ছে? সেই একই রকমভাবে সবচাইতে প্রবীণ মানুষটি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন শরশয্যায়অর্থাৎ ব্যথাকে প্যাচপ্যাচে বিশ্বাসযোগ্য বানাতে নীতি, দ্বন্দ্ব, রাজনীতির কি অনাবিল হাস্যস্পদ আস্ফালন। আসলে যীশুকে তো শুধুমাত্র পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পাথর ছুঁড়ে (কেননা তখন রিভলভার ছিলো না) একবারই থেঁতলে মারলে বা তলপেটে সোজাসুজি অস্ত্র ঢুকিয়ে দিলে ধর্মীয় বিড়ম্বনার সঙ্গে খুনসুটি করা সার্থক হয়ে উঠবে না। অতএব ইশ্বরের পুত্রকে খপ্পরে পড়তে হলো ব্যথার। লেখা হলো ব্যথা বীরোচিত আখ্যান। অবশেষে কিনা সমস্ত আয়োজনকে মাত্রাতিরিক্ত দগদগে উত্তেজনা দেওয়ার জন্য পড়ানো হলো কাঁটার মুকুট! এদিকে তৃতীয় পাণ্ডবও সেই বালখিল্য আবেগে একই নিপুণ দক্ষতায় গড়ে দিলেন শরশয্যা। স্বীকৃতি দেওয়া হলো ব্যথাকে। আর যখন ধর্মের হাত ধরে শিল্প চোখ রাখলো একটা ক্যালাইডোস্কোপের ভিতরে! তখন কি হচ্ছে? দেখছি সেখানেও ব্যথা-যন্ত্রণার আবহ রঙিন নক্সার মতো মিশে যেতে শুরু করল নীরবে সময়ের গর্ভে।

সমকাল- সময় কিন্তু স্বচ্ছতা নিয়ে উদগ্রীব হয়ে থাকতে চায়নি। আর তাই ব্যথার মোড়ক কোন কুয়াশাঘেরা পথে ইতিহাস পাড়ি দিয়েছে তা ধরে রাখা সম্ভব হয় না কিন্তু ঘটমান অতীতের সেই ছাপগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে বিস্ময়ান্বিত হওয়া যায় শুধুমাত্র। শিল্পের ইতিহাস যদি ওল্টাতে যাই আর সামনে কী-ওয়ার্ড যদি ব্যথা হয় তবে থমকে যায় সমগ্র বাহ্যিক অভিব্যক্তি। মনের গভীরে ঘুরপাক খায় শতাব্দীর পুরাতন বহু শিল্পীর তুমুল চড়াই-উৎরাই। এই সবকিছুর মধ্যেও যে সকল শিল্পীর জীবনের কাছে এসে সর্বাপেক্ষা বেশী থমকে থেকেছি, সীমাহীন আক্রান্ত হয়েছি; তাদের জীবনে ব্যথা আর সকল কিছুর জীবনবোধের মতো, শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই প্রতিনিয়ত, শাশ্বত। এক এক সময় মনে হয়েছে ব্যথার ভারে ভোঁতা হয়ে যাবে হয়তো জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো, কিন্তু না খুঁজতে গিয়ে বরং দেখেছি দুর্নিবার জেদের সামনে সে সবকিছু পরাস্ত হয়েছে। মন্ত্রপূত কবজের মতো শিল্পবোধ রক্ষা করে চলেছে শিল্পীকে, মর্মভেদী হয়ে উঠেছে বিরামহীন সৃষ্টির পথ। হতচকিত হয়ে গিয়েছে ইতিহাসও, আবার কোথাও রাজকীয় ঐতিহ্য পাতলা হয়ে গিয়েছে অন্তর্মুখীনতায়। বেশীরভাগ সময় মনে হয়েছে আত্মকরুণা জীবনকে আরো বেশী করে ঠেলে দিয়েছে প্রাত্যহিক ব্যথার উদ্‌গীরণে। বখাটেপনার অনিবার্য শৈল্পিক বৈপরীত্য, নেশার জগতে বেজে ওঠা নিরন্তর বিউগল যুদ্ধকে ঠেলে সরিয়ে এনে আচ্ছাদিত করছে ছোট্ট এক একটি ঘরে, কখনো সেটি পরিণত হয়েছে শিল্পীর আঁকার স্টুডিয়োতে, কখনো অ্যাসাইলাম আবার কখনো তা হাসপাতালের সাদা চাদরে মোড়া লোহার বিছানা। যুদ্ধটা চালিয়ে যেতেই হয়েছে ব্যথার সঙ্গে; শারীরিক যন্ত্রণা ও প্রতিকূলতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে।

এ ব্যথার ধরণ আবার অন্য। কুঁড়ে কুঁড়ে খায় সারাক্ষণ। আর কিছু নয়, সাদামাটা বাংলায় যাকে বলি অবসাদ অর্থাৎ সর্বক্ষণের মন খারাপ, নাছোড়বান্দা এক মনের অসুখ। মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে আটবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে গঘকে এই মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই জারী রাখতে। হ্যালুসিনেশন, অবসাদ, বিভ্রান্তি, অস্বাভাবিকতা, অস্থিরতা-র মতো ক্ষয়িষ্ণু অসুখগুলোর কাছে জীবনের অঙ্গীকারগুলোকে সঁপে না দিয়ে তৈরী করে গিয়েছেন সর্বক্ষণ তারায় ভরা আকাশ, ফসল ভরা মাঠ বা সাইপ্রাসের বন। সমস্তরকম দুঃসহ যন্ত্রণার মাঝেও কখনোই কোনো নেগেটিভিটিকে কিন্তু ছবিতে অন্তত গঘ প্রশ্রয় দেননি। ঐ যে হাফগ্লাস জল খালি না ভর্তি ছোটবেলায় এই ধাঁধায় গঘের ব্যক্তিজীবন যদি সর্বদাই অর্ধেক খালি হয়ে থাকে তো শিল্পের খোঁজগুলি কিন্তু ঝুঁকে ছিলো সবসময়ের জন্যই অর্ধেক ভর্তির দিকে। ঊনত্রিশ বছর বয়সে (১৮৮২) ভাই থিওকে গঘ লিখছেন-
I am often terribly melancholy, irritable, … terribly sensitive, physically as well as morally, the nervousness having developed during those miserable years which drained my health.
এই স্বচ্ছসরল স্বীকারোক্তি কিন্তু সহজ নয়। নিজের কাছে নিজের গ্লানিকে মান্যতা দেওয়া এবং সেই জীবনের সঙ্গে শিল্পের বিবাদ ও তাকে ঘিরে যৎযাবতীয় আপোস ও আপোসহীনতার রোজনামচা, গঘকে কোন চরম বিস্মরণের পথে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলো তার সাক্ষী হয়ে থেকেছে ইতিহাস। গঘের আত্মহত্যা, তার শিল্প, জীবন, সম্পর্ক এ’সবকিছুর সম্মুখীন হয়ে যেন নান্দনিকতা, নন্দনতত্ত্ব নতুন মাত্রা খুঁজে পেয়েছে, উন্নীত হয়েছে অনেক ধাপ। একটা মানুষ ক্ষুর চালিয়ে দিতে পারে নিজের কানে আর সেই ব্যথাকে ধরে রাখতে পারেন ছবিতে। তীব্র ক্ষোভে কখনো গগ্যাঁকে আক্রমণ করছেন, কখনো কাঁচ ছুঁড়ে দিচ্ছেন তার দিকে, সকলকে খুন করতে চাইছেন, কফিতে লবন মিশিয়ে দেওয়ার অমূলক অপরাধের জেরে আবার এইসকলকিছুকে “an electric battery after it has run down- বলে জীবনের প্রতি কি প্রকট তাচ্ছিল্যকে উস্কে দিচ্ছেন। গগ্যাঁর সঙ্গে শিল্পগত মতপার্থক্য, মিথের প্রাধান্যকে জীবনের ওপর স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে যে মনোমালিন্য তা পরবর্তী সারা বিশ্বের কাছে এক অনবদ্য শৈল্পিক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত গড়ে তুলবে, এও ছিলো এক অদৃষ্ট। এসব কিছুর পাশাপাশি গঘের কাজের যে দিকটি আমাকে সবচাইতে বেশী ভাবায় সবসময়ের জন্য তা হলো – যিনি কষ্ট পাচ্ছেন হ্যালুসিনেশনে, তার ছবিতে কিন্তু কোথাও অমূলক ভাবনার স্তর যুক্ত হচ্ছে না। দুপুর বারোটার রৌদ্রস্নাত শস্যভূমিকে যেমন জীবন্ত তুলে ধরছেন তেমনি বেলা চারটের পড়ন্ত বিকেলে রৌদ্র ভেজা চারণভূমির অলসতা মথিত করছে আবহকে। রাতের আকাশের অভিব্যক্তিতে কোথাও কোনো জড়তা নেই। রাতের অন্ধকারটুকু যেন নিংড়ে নিচ্ছেন গঘ শুধু ব্যক্তিজীবনে। ১৮৮৯-এ মৃত্যুর এক বছর আগে ভাই থিওকে যথার্থই লিখছেন-
They say- and I am very willing to believe it- that it is difficult to know yourself- but it isn’t easy to paint yourself either.” কোন মোহ থেকে কান কেটে উপহার দিতে পারেন প্রেমিকাকে? কিভাবেই বা অবসাঁত মত্ত জীবনে মাতাল থেকেছেন প্রকৃত অর্থে জীবনের সূক্ষ্ম ক্ষণ গুলিকে ধরতে! কৃষকের ঘাম, কয়লা শ্রমিকদের ভাঙ্গাগড়ার ছন্দ থেকে শুরু করে শেষ লগ্নের গনগনে আগুনে পুড়ে যাওয়ার দিনগুলিতে আহারনিদ্রাহীন টগবগে বা ঝিমধরা শিরায় শুধুই রঙ মেখেছেন। স্নাত হয়েছেন রৌদ্রে আর স্নায়ুদের আচ্ছন্ন রেখেছেন কড়া তামাক আর মাদকে, জন্ম দিয়েছেন অজস্র অনুভবের ঐশ্বরিক ছদ্মময়তা। প্রকৃতই এ এক চন্দ্রাহত শিল্পীর রূপকথার আখ্যান।


(২)
শিল্পের জগতে আরেক বিস্ময় তুলুজ লত্রেক। লত্রেকের জীবন জানার আগে অনুধাবন করতে পারিনি ছবির ঐ সাবলীল শক্তিশালী রেখাগুলোর উৎস। আর যখন মানুষটা একটু একটু করে ধরা পড়ল তখনই ততোধিক বেশী করে ছবির রেখার দাপট, রঙের বিন্যাস প্রকৃত ধরা পড়তে শুরু করলো। জিনগত অসুখের প্রকোপে পড়ে সারাটা জীবন কাটালেন শারীরিক ও মানসিক দোলাচলের মধ্যে। ছোট থাকতে দুই বছর পর পর দু’পায়ের ফিমারের মাঝখানে ভেঙে যাওয়ায় যে মানুষটির উচ্চতাই আর বাড়লো না, সাড়ে চার ফুটের ক্ষুদ্রকায় এক মানুষ হয়ে রয়ে গেলেন অথচ ছবিকে নিয়ে গেলেন অনন্য এক উচ্চতায়। ভালোবাসার নারীদের প্রহসনের কাছে জীবনকে সঁপে দিয়ে একের পর এক অনবদ্য সামাজিক যাপনচিত্রে আচ্ছাদিত করে গিয়েছেন ক্যানভাসগুলিকে। ব্রথেলের দিনগুলিতে যন্ত্রণার পাশাপাশি মায়া আবিষ্ট হয়ে বসবাস করেছেন পরম স্নেহে বারবিলাসীদের সঙ্গে। উদ্দাম সেই জীবনযাত্রার অবধারিত পরিণতি হয়েছিলো মানসিক ভারসাম্যহীনতা। কোনটা বেশী যন্ত্রণার এক শিল্পীর কাছে, জীবনের অভাববোধ নাকি সৃষ্টির থেকে দূরে সরে যাওয়ার অনিবার্যতা। কতটা কষ্ট হয়েছিলো সে সকল দিনগুলিতে যখন তীব্র অনীহা চেপে বসেছিলো স্নায়ুর ওপর আর লত্রেককে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো সৃষ্টির আনন্দ থেকে! শেষ জীবনে ছবি আঁকতে পারেননি, ক্রমে দু’পা অকেজো হয়ে গিয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফল দু-দু’বার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, এদিকে ততদিনে শরীরে সিফিলিস বাসা বেঁধেছে গভীরভাবে। কিন্তু কে বলতে পারবে এই অপরিসীম শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও তার সৃষ্ট ছবির সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজারের ওপর, যার মধ্যে ৭৩৭ টি ক্যানভাস তাকে প্রতিষ্ঠার শিখরে নিয়ে যায় অনায়াসে, ইতিহাস স্বীকৃতি দেয় সৃষ্টির। লত্রেকের ছবিতে স্পেস্‌ সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে জাপানী শিল্পের প্রভাব দেখা যায় তা পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আর্টকে নতুন দিগন্তের খোঁজ দেয়।

মুল্যাঁ রুজে বসে লত্রেক এঁকে চলেছেন একের পর এক মানবীর শরীর এবং তাদের ঘিরে সামাজিক অনুষঙ্গ। রেখায় যে বোল্ডনেস তা লত্রেকের মানসিক একরোখা মেজাজকে প্রকাশ করে। খুব কম রেখার ছোবলে তুলে আনছেন সে সময়কার ডাকসাইটে সব সুন্দরীদের শরীর, মুখ; একের পর এক আঁকছেন জেনী আরভিল, মে মিলটনের অবয়ব। বারবিলাসিনীদের উন্মত্ত ব্যালে ডান্সের ক্যানভাসে যে ক্ষিপ্রতা যুক্ত করছে, তার ভারসাম্য এক কথায় অনবদ্য। একথা সকলেই পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট যুগের সমকালীন শিল্পীরা মেনে নিয়েছিলেন যে ড্রয়িং-এর দিক দিয়ে লত্রেক ছিলেন সবচাইতে এগিয়ে। একাধিক শরীরের সমাবেশে কোনো দৃশ্যপট রচিত হয়েছে যেখানে, কোনো শরীর যেমন আলাদা করে চোখকে আকৃষ্ট করেনা, তেমনি প্রতিটি ফিগার সুনির্দিষ্ট বিষয়ভারে বন্টিত। লত্রেকের যৌন জগতের বিচিত্রতা প্রকাশিত হয়েছে ছবিগুলিতে। ‘লা টয়লেটে’ ছবিটি যেমন। যেখানে উন্মুক্ত পিঠের উন্মনা যে নারীর শরীর লত্রেক আঁকলেন ১৮৯৬ সালে, তা মনকে আবিষ্ট করে রাখতে পারে রেখাদের বলিষ্ঠ টানটান ঐক্যতানে। রঙের আবেশতা ছড়িয়ে পড়ে অনুভূতির প্রত্যাশিত ভেজা আকাশে, আর এভাবে একটি বাথরুমের খণ্ডচিত্র হয়ে ওঠে ভণিতাবর্জিত যাপনের নিত্যসঙ্গ হওয়ার সাথী।

এদিকে যে মানুষ ফিগার স্কেচের ক্ষেত্রে ঐশ্বরিক দক্ষতা অর্জন করে চলেছেন প্রতিনিয়ত তিনি নিজেই নিজের শরীরী গঠনের জন্য সামাজিক হাস্যস্পদ বস্তুতে পরিণত হয়েছেন একাধিকবার। জেনেটিক ডিফরমিটির জন্য মুখে নাকে যে অসংলগ্নতা প্রকট হয়ে ওঠে এবং একইসঙ্গে ছোটবেলার অপরিণত পায়ের জন্য লত্রেক নিজেকে ঠেলে দিয়েছিলেন আরো বেশী করে অবসাদের মধ্যে। অতৃপ্তি এবং বেখেয়ালীপনার চূড়ান্ত পরিণতিতে দিগ্বিদিক ভারসাম্যহীন জীবন কাটাতে যেখানে বাধ্য হয়েছেন লত্রেক মৃত্যুর আগে শিল্পের থেকে সৃষ্টির থেকে দূরে সরে থাকতে। শিল্পের এক সংক্রামক আত্মতৃপ্তি সারাজীবন যে শিল্পীকে শুধু ঘাড় গুঁজে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছে তুখোড় ক্ষতিগ্রস্ত বেঁচে থাকাকে।


(৩)
সারা শরীরে ব্যথা। তবু আঁকতে চাইছেন। বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা নেই, নেই চলাফেরা করার শক্তি। তাড়না তবু মজ্জাগত। সারা ঘর, ছাদ মুড়ে ফেলেছেন কাঁচ দিয়ে, আর তাতে নিরন্তর দেখে চলেছেন নিজেকে। আঁকতে শুরু করে দিয়েছেন নিজেকে। ভাঙ্গা শিরদাঁড়া। অস্ত্রোপচার, এসব কিছুর ঊর্ধ্বেও যে জীবন, তার প্রতিফলন ফ্রিডার ক্যানভাসগুলো। জীবনের থেকেও যেখানে বড় হয়ে ধরা পড়ছে শিল্পবোধ। এ বাস্তব সারা পৃথিবীতে তিনি নিজেই। কি রকম ছিলো সেই মুহূর্তটি যখন লোহার রডটি ঢুকে গিয়েছিলো দেহে? অথবা বেশী তীব্র ছিলো কি ছোটবেলার পোলিও সংক্রমণের ব্যথা! না কি ফ্রিডার কাছে অনেক বেশী যন্ত্রণাদায়ক ছিলো মাতৃত্বের থেকে বঞ্চিত থাকার অদৃষ্ট? বারবার মিস্‌ক্যারেজ হয়েছে যে নারীর জীবনে, যে নারীকে বার তিনেক অ্যাবরশন করাতে হয়েছে; কেমন ছিলো সে নারীর নিজের শরীরের প্রতি ভালোবাসা? কতটা শিল্পের প্রতি তীব্রতা থাকলে একটি পা-কে বাদ দিয়ে এঁকে নিজের ডায়েরীতে লিখে রাখা যায় “I am Disintegration; - আর এসব কখন হচ্ছে? গ্যানগ্রিন হওয়া ডান পায়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির যখন একটাই মাত্র পথ সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো – অ্যাম্পুটেশন।

এতো মিথ জন্ম নিয়েছে যে শরীরকে নিয়ে, যে শরীরের তীব্র ব্যথার কাছে একটা সময় এসে চিকিৎসাশাস্ত্রও নিরুপায় হয়ে উঠেছে, সেই মানুষটি কিন্তু কেমন যেন যাদুর মোড়কে ঘিরে দিতে পেরেছেন সকল যন্ত্রণাকে। সর্বক্ষণের ব্যথার থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ খুঁজে পেয়েছেন ক্যানভাসগুলোতে- শিল্পে। দিনের পর দিন যখন ব্যথা ভুলে থাকতে সাহায্য নিতে হয়েছে মরফিনের, অ্যালকোহলের; কতটা শক্তি লেগেছে সেই মানুষটির ক্যানভাসে মাই বার্থ (১৯৩২) বাস্তব করে তুলতে? কি অপরিসীম জীবনের প্রতি ঔদ্ধত্য থাকলে এই জন্মক্ষণের আত্মচিৎকারকে ধরা যায়! আঁকা যায় নিজের জন্মমুহূর্ত!

কোন যন্ত্রণা মানুষের কাছে বেশী? শারীরিক? মানসিক? না কি আত্মগ্লানির যন্ত্রণা! প্রতারিত হওয়ার অমর্যাদা? ফ্রিডার কাছে কোন ব্যথার দিকটি সবচাইতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো, তা অনুধাবন কড়া অসাধ্য। জীবনে পরতে পরতে পলির মতো এই মানুষের জীবনে দুঃখরা জমেছে, আর জমাট বেঁধে শক্ত পাথরের মতো সে যন্ত্রণা ফ্রিডাকে দিয়ে প্রকাশিত করিয়ে নিয়েছে আত্মপ্রতিকৃতির স্বতন্ত্ররূপগুলিকে। সত্যিই জানতে ইচ্ছে করে জীবন প্রকৃত অর্থে ফ্রিডাকে কি দিয়েছিলো!

ব্যথার থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি ঘটনাকে পরিণত করেছিলেন পরিহাসে, আচ্ছন্ন থেকেছেন নাটকীয়তায়/ পেলভিসে ঢুকে যাওয়া লোহার রডের ক্ষতের অনিবার্যতাকে ঢাকতে অবলীলাক্রমে কটাক্ষ করে বসেন-
I lost my virginityফ্রিডার জীবনীকার এইচ. হেরেরার কাছে একাধিক ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত করেছেন নিজেকে এভাবেই- ফ্রিডা।

হেনরী ফোর্ড হসপিটাল। যন্ত্রণার এমন অনবদ্য ভাষা এর আগে ক্যানভাসে সরাসরি দেখানো হয়নি। সন্তান সম্ভাবনার পনেরো দিনের মধ্যে ফ্রিডাকে সহ্য করতে হয়েছে মিস্‌ক্যারেজের যন্ত্রণা- আর সেখান থেকে জন্ম নিয়েছে ক্যানভাসে নগ্ন ফ্রিডার হাসপাতালের শয্যায় শোয়া রক্তভেজা শরীর যেখান থেকে উম্বিলিক্যাল কর্ড ছয়দিকে ছয়টি ছড়িয়ে রয়েছে রূপকার্থে অর্কিডরূপে, অ্যাবডোমেন সহ বা সময়ের শ্লথতা বোঝাতে শামুকরূপে; এসেছে অনুসঙ্গ হয়ে ম্যাজিক্যাল অ্যাপারেটাস এবং সন্তানধারণের অক্ষমতার প্রধান কারণ সেই পেলভিস ও শিরদাঁড়ার আঘাত যার পরবর্তী ফল ছিলো ফ্রিডার স্বপ্নের ভ্রূণের বারবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার বেদনা। নারীত্বের, মাতৃত্বের, আকাঙ্ক্ষার এমন সরাসরি ভাষ্য তাই ফ্রিডার ছবি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখাতে শেখায় জীবনকে তার অনিবার্যতাগুলোর সঙ্গে লড়াইকে। শারীরিক যন্ত্রণা অক্ষমতার পাশাপাশি ফ্রিডার কাছে রিভেরার সঙ্গে বিচ্ছেদ জীবনে ডেকে এনেছিলো অবসাদ। যদিও ব্যক্তিজীবনের এইসব আঘাতই জন্ম দিয়েছে আত্মজীবনীর। এতো সহজবোধ্য ভাবে কয়জন মানুষ পেরেছেন নিজেকে মেলে ধরতে। ফ্রিডার প্রকাশিত স্বত্ত্বা এভাবেই ছুঁতে চেয়েছে নিজেকে, শিল্পকে, সমকালকে।


(৪)
ব্যথার কথা কে বোঝে? আদৌ কেউ বোঝে কি? বা বুঝতে চায় কি কেউ? এক শিল্পী কি বোঝেন আরেক শিল্পীর ব্যথা? গঘের ব্যথা কতটা বুঝতেন গগ্যাঁ বা লত্রেক? বা ফ্রিডার ব্যথা রিভেরা! হয়তো এই মানুষগুলিই বুঝতেন সবচাইতে বেশী। আবার আঘাতও করেছেন সবথেকে বেশী এই মানুষগুলিই। আত্মহত্যার আগে পর্যন্ত গঘ আর লত্রেকের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো, সেই কুড়ি বছর বয়সে যখন লত্রেক প্যারিসে চলে এসেছিলেন ঠিক তখন থেকেই গঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব। মুল্যাঁ রুজে কাটিয়েছেন দু’জন একসঙ্গে বহু সময় কিন্তু দু’জনে দু’জনের সঠিক খোঁজ কি রাখতে পেরেছিলেন! মিলটা কি শুধু এইটুকুই ছিলো যে দু’জনেই যন্ত্রণাপিষ্ট জীবন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে? নাকি কোথাও দু’জনেই সমমনস্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন জাপানী শিল্পরীতির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে! অদ্ভুত এইসব সমাপতন। ভ্যান গঘ আর তুলুজ লত্রেক ইমপ্রেশনিস্টদের দুই দিকপাল, তাদের মুল্যাঁ রুজের জীবন শিল্পের দুনিয়ায় যুক্ত করেছে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। সেখানে লত্রেক তার যৌন জীবন অতিবাহিত করেছেন ব্রথেলে এবং সেখানকার রোজনামচার সঙ্গে একাত্ম করে নিচ্ছেন শিল্পবোধকে, সেখানে দাঁড়িয়ে গঘের প্রেম, প্রত্যাখ্যান, সজীবতা ধাক্কা খাচ্ছে, সম্মুখীন হচ্ছে অবসাদের নিম্নগামী চোরা গলিপথের। জন্ম নিচ্ছে ক্রোধ, চাহিদা, অগাধ পাগলামির এক অসঙ্গত কম্পিত মায়ারাজ্য।

ওদিকে ফ্রিডার জীবনে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক বিনাশের সাতকাহন। ফ্রিডার বোনের সঙ্গে রিভেরার সম্পর্ক ধ্বস্ত করে দিচ্ছে সম্পূর্ণ বিশ্বাসবোধকে আবার একটু অন্যদিকে ফিরে তাকালে ফ্রিডাকে দেখছি দিব্যি মেতে আছেন দেশজ ও স্থানীয় উপাচারগুলির মধ্যে। ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে ছবিতে সোচ্চার হচ্ছেন আবার প্রকাশিত করছেন কমিউনিস্ট ভাবাদর্শকে নিজের কাজের মধ্য দিয়ে। নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার বাইরে বেরিয়ে আসার করিডর রচনা করে চলেছেন সর্বক্ষণ। গুমোট কোনো ঘোলাটে রঙে মুড়ে ফেলেন নি ক্যানভাসকে বরং শিখিয়ে গিয়েছেন কিভাবে যতো ক্ষুধার্ত হওয়া যায়, ততই বেশী রঙিন করা যায় ক্যানভাসকে, নিরেট করা যায় কারুকাজকে, জীবনকে।

আসলে তারা কেউই জীবনে ব্যথার কাছে স্বাধীনতা হারাননি। যত বেশী যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়েছেন ততো বেশী করে অস্বীকার করেছেন করুণাকে। বীরোচিত করুণাকে লোকারণ্যে খুঁজে নিতে চেয়েছেন লত্রেক আবার সমাহিত নারীত্বের উদযাপন স্বীকৃতি পেয়েছে ফ্রিডার কাজে আর গঘ দারিদ্র্যের পেশীকে দুর্বল করে শীর্ণকায় খুঁজে দেখেছেন শহরতলিতে প্রকৃতির বিরামহীন পরিভ্রমণ। এসবকিছুর মধ্য দিয়ে তাই ব্যথার সংজ্ঞাটাই যেন বদলে যায়। ব্যথা বলতে ঠিক কাকে বুঝবো আমরা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সত্যিই কি একটা ‘স্টারি নাইট’ বা চষা ক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে, বা ধরুন ফ্রিডার আত্মপ্রতিকৃতির ক্যানভাস অথবা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে; অথবা লত্রেকের মুল্যাঁ রুজের উৎসবের মধ্যে একাত্ম হয়ে বলে উঠতে প্রাণ চায় না – ব্যথা নেই আর কোনো। আমার কিন্তু মনে হয়। সত্যিই মনে হয়- ব্যথা নেই আর কোনো।

উৎসসূত্রঃ ১। Lust for life by  Irving Stone.

         ২।The Life & Works of Van Gogh by Michael Howard

 ৩। Noa Noa by Paul Gauguin

 ৪। A Concise History Of Modern Painting by Herbert Read

 ৫। Moon and Sixpence by W Somerset Maugham

 ৬। Moulin Rouge, Roman um Henri de Toulouse-Lautrec by 

  Pierre La Mure 

 ৭। The Social History of Art by Arnold Hauser

 ৮। A Biography of Frida Kahlo by Hayden Herrera 

 ৯। Dear Theo: The Autobiography of Vincent Van Gogh edited by Irving Stone & Jean Stone.

---
 


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments