এটা গল্প হলেও পারত | তাপসকিরণ




              রমাকান্ত নামা – আয়না দর্শন | তাপসকিরণ রায়

[শ্যাডোগ্রাফি: অমর সেন ও সব্যসাচী সেন | সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘নির্বাক’]

মুখ নাকি মনের দর্শন। কিছুটা এর সত্য বটে, তবে ব্যতিক্রমী উদাহরণেরও অভাব নেই। এই রমাকান্তর কথাই ধরা যাক। ভাগ্যবশত যদিও চরিত্র হনন তাঁর হয় নি। কিন্তু মনের মধ্যে মন্দের ঘাঁটাঘাঁটির তাঁর অভাব নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে টেড়ি কাটতে গিয়ে নিজের দিকে তাকান তিনি। এক নিরীহ ভদ্র মানুষের ছবি ভেসে ওঠে। সাধু সন্তদের কাছাকাছি এক মুখমণ্ডল যেন! আহা নিজেকে দেখার কিন্তু একটা সুখ খুঁজে পান তিনিযেমনটা কেষ্টদেব এক জাগায়, নিজেরে হেরিয়া নিজেই ভুলিনু, বলে উঠে ছিলেন। এমন মত একটা ভাব রমাকান্তর মনে জেগে উঠে। কিন্তু আসলে এ চেহারার কতটা সত্যি?
--কি গো সখা, তুমি তো তেঁদড় কম নও! নয়নীদি বলেছিল। 
--কেন, কেন? হেসে প্রশ্ন করেছিলেন রমাকান্ত। 
--এই তো দেখো না, তোমার রূপছটায় গোপিনী পটে যায়, আর তুমি অপারগ হলেও তাদের চির হরণ করতে চাও! 
--কেন-তুমি আমার মনটা দেখতে পাও নাকি?
--তা কেনে গো ঠাকুর, তোমার শান্ততার মাঝে আমি যে চঞ্চলতা দেখে নিয়েছি গো! রমাকান্ত বুঝে ছিলেন নয়নী সেদিনের ঘটনারই ইংগিত দিচ্ছিল।   
--তবে এস না গো তোমার সঙ্গে প্রেম করি! তবু রমাকান্তর রসনাগর হতে ভাল লাগে, হোক তা নিষ্কাম প্রেমের
--দুস মিনসে, সুযোগ পেলে তুমিও চরিত্রহীন হতে গো, সখা!
--কিন্তু আমার যে শখ ছিল তুমিই কাছে এলে না সখী!
এবার যেন আসল ছবিতে এসে পড়ে, নয়নীদি, বলে, ধুস দামড়া!  

বৈষ্ণবী আখড়ায় থাকে নয়নীআখড়ায় দশ বারো ঘর জোড়ে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর বাস। বেশীরভাগ এরা দিনে ঘুরে বেড়ায়, গান করে ভিক্ষা করে। মনের যন্ত্রণা দুরে ঠেলে রাখার চেষ্টা করে। 

এই নয়নী একদিন ভুলে ভটকে রমাকান্তর ঘরের দ্বারে এসে পড়ে ছিল। সঙ্গে মাধ বৈষ্ণবও ছিল। কপালে তিলক কাটা সাদামাটা বেশ, একতারা বাজাচ্ছিল মাধ, নয়নী দুলকি চালে নেচে নেচে গান গাইছিল যাতে বিনয় দীনতা আর ওই শূন্য আকাশ নিয়ে বিরহ বেদনা মিশে ছিল

রমাকান্তর স্ত্রী, শৈলবালা কাজের লোক না আসায় কাপড় কাচতে বসে ছিলেন, বলেছিলেন, দেখ তো কারা এলো? রমাকান্ত দরজা খুলতেই চোখে পড়ল নয়নী আর মাধকে। মাঝ বয়সী বৈষ্ণবী, মেদহীন, জৌলুস শরীরকপালে লম্বা তিলক আঁকাসাধ্বী চেহারায় যেন উদার প্রকৃতি ধরা! ভাব বিভোর ঢুলু ঢুলু চোখ, হাসির রেখা পেলবে কেমন মায়া জড়ানো ভাব! রমাকান্ত বৈষ্ণবীকে নিষ্পলক দেখে যাচ্ছিলেন। 
--আমরা মাধব পাড়ায় থাকি গো বাবু! মাধ বলে উঠেছিল। 
--মাধব পাড়া? সে তো অনেক দূর! রমাকান্ত উদাসী হয়ে বলে ছিলেন। 
--তা ঠিক বাবু! মিটিমিটি হাসি লাগা ছিল নয়নীর চোখে মুখে, এসো না গো একবার আমাদের গরীব আখড়ায়! 
রমাকান্তর মনে হল নয়নীর চোখটা যেন পিটপিটিয়ে উঠেছিল! মিনিট পনেরোর মত কথা হয়ে ছিল। নয়নীর বয়স মাপলে রমাকান্তর চে বড়ই হবে। তা হোক ওর মন ভোলানো গান আর দুলুনি চাল রমাকান্তকে কি মজিয়ে দিয়েছিল সে দিন?

আবার আয়নার দিকে তাকালেন রমাকান্তএক ভোলা ভালা ছবি লেগে আছে কাঁচে। এই জলছবির আড়ালে কত যে প্যাঁচ কামড় রয়েছে সে শুধু নিজেই জানেন!  

বউ ফাঁকি দিয়ে একদিন সত্যি তিনি হাজির হলেন মাধব পুরে। নয়নীর সাথে দু’দণ্ড কথা বলে স্ফূর্তি এলো মনেতারপর অনেকটা নেশার মত হয়ে গেল- ঘর পালিয়ে, অফিস পালিয়ে নয়নীকে দেখতে যান তিনিমাধ ঘরে থাকলে রস উচ্ছ্বাস একটু কম হয় এটা ঠিক। 

একদিন নিভৃতে নয়নীকে পেয়েছিলেন রমাকান্ততিনি সাহস ভরে বলে  ছিলেন, কি গো, কার জপ করছ হৃদয়ে?
রসিকা নয়নী বলে উঠেছিল, আমার কেষ্ট ঠাকুরের গো, তুমি তো আমার কেষ্ট ঠাকুর!
--সত্যি? রমাকান্ত রসাপ্লুত হয়েছিলেন, তবে এস না আমরা দুজনে ঝুলনে দুলি! তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন নয়নীর দিকে। সত্যি এ বয়সেও নয়নী তন্বী, কথাও তো ধরে রাখা লুকোনো শরীরের ধার এখনও অনুভব করা যায় নয়নী, এসো না আমার আরও কাছে!
নয়নী তবু স্থির হয়ে একই জাগায় বসে ছিল। তার মুখ চোখ যেন ঈষৎ হাসছিল। আশকারা পেলেন রমাকান্ত, তিনি ঝট করে নয়নীর একেবারে কাছটায় গিয়ে এক চুম্বন সেঁটে দিলেন। 
--আঃ, কি হচ্ছে রমা, নিজেকে দুরে সরিয়ে নিয়ে ছিল নয়নী থমথমে হয়ে গিয়ে ছিল তার মুখ। রমাকান্ত থেমে গিয়েছিলেন। এমন বিঘ্নতা তিনি আশা করেন নি। এমন লাস্যময়ী নারীর এমন বৈপরীত্য কেন! লালচ দৃষ্টি তখনও রমাকান্তর চোখে মুখে ধরা ছিল। 
--তোমাকে আমি সখা ভাবি ঠিকই, কিন্তু তুমি আমার অনেক ছোট- কাম ভাবনা আমার ওপরে রাখবে না, আজ থেকে তুমি আমায় দিদি ডাকবে। তা না হলে এখানে আর কোন দিন আসবে না। 
রমাকান্তর মাথা ঝুঁকে পড়েছিল। 
--দেখো রমা! ভালবাসা নিষ্কামও হয়- তোমার আমার ভালবাসা নিষ্কাম ভালবাসা জেনো। 
আয়না মানুষের প্রতিচ্ছবি দেয় মাত্র- এ দর্শনে মানুষ চেনা যায় না। এ ঘটনার পরেও রমাকান্ত অনেকবার নয়নীদি’দের আখড়ায় গিয়েছেন। নয়নীদির নিষ্কাম ভালবাসা রমাকান্ত মেনে নিয়েছিলেন।

                                                                                           
 | |


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments