অনুগল্প | নীলাঞ্জন




                       ফটোফ্রেম | নীলাঞ্জন দরিপা

[আলোকচিত্র: অঙ্কিত শর্মা]
রাস্তার মাঝে বৃষ্টি নেমেছে জোরে, পাশে নামতে পারে নি সেভাবে বাড়ি, দোকানের ছাউনির জন্য। গ্যালো কাত্তিকে রেলে কাটা পড়ল গন্নাকাটা খগেন, পরের ট্রেনটা একটু লেট করেছিল স্টেশন পৌঁছতে, এর বাইরে আর কিছু ক্ষতি হয় নি তাতে। খগেনের মায়ের বিরাশি না বিরানব্বই তা আর বোঝার উপায় নেই, একটা তার থেকেও বেশি পুরনো কাপড় গায়ে মাথায় সেঁটে গ্যাছে বৃষ্টির দাপটে। মোড়ের ঠিক মাঝে, মাঝখান থেকে বেঁকে যাওয়া বুড়ো গাছটার তলায় দুমড়ে পড়ে আছে বুড়ি। মরে নি, নির্ঘাত। আহ্, হাত বাড়াবেন না, আঙ্গুল যতই সুড়সুড় করুক, মানছি জিভ থেকে জল ঝরানোর মত ফটোজেনিক ব্যথাকিন্তু আমাদের গল্পে অত দামী ক্যামেরা নেই। পর্যটনে আসা শখের শহুরে বাবুও নেই। আছে কাক, কাকতাড়ুয়া আর ম্যাদামারা দেওয়াল লিখন।
খুব খাপছাড়া লাগছে কি? তাহলে এই তেমাথা মোড় থেকে তিন দিকেই খানিক এগিয়ে, ঘুরে আসি চলুন। ওই যে লক্ষ্মীদের ঘরের পচে যাওয়া বেড়ার পাশ দিয়ে সোজা পথ, ওটা নাকি বিহারের দিকে গ্যাছে। মাইল দশেক হাঁটলে বড় রাস্তায় ওঠা যায়। আর বাঁদিকে তুলনায় চওড়া যে রাস্তাটা থেকে জল ছিটকে ছিটকে উঠছে ধুলো নিয়ে, ওটা এসেছে সদর থেকে পাঁচখানা গ্রাম পেরিয়ে। বাউরি পাড়ার পর এই গোলমুড়া গ্রাম। কি করে এ নাম হলো, তা এখন আর কেউ জানে না বোধ হয়। লক্ষ্মীর জ্যাঠা যখন বিন্তির কোলে, তখন বিন্তির শ্বশুরের শ্বাস ওঠে। তারপর থেকে আর কেউ এ গাঁয়ে মুরুব্বির তকমা পায় নি। পাঠশালার জমিতে ছাগল চরে, লক্ষ্মীদের ভিটে পেরিয়ে, নুরদের ফটক থেকে সামনেই জায়গাটাআমরা ঠিক যেখান থেকে খগেন এর মাকে দেখছি সেটা শ্মশান এর পথ। এ পথ দিয়ে বিকেলের পর কেউ বাঁশবনের বেশি যায় না। খগেনদের বাড়িটা আর নেই, তবে মেহগনি গাছটা আছে, কে যে কবে এনেছিল শহর থেকে এই গাছ, খগেনের মা হয়ত জানে, তবে বুড়ি আর বলে না। কথা বলে না। গাছটার ছায়া যখন মোড় পেরিয়ে সামনের ছাই ঢিবি ছুঁয়ে ফ্যালে, তখন হারুন সদরের দিক থেকে ফেরে। রোজ সে শহরে যায়, কি করে না করে সে খোঁজ রাখে না ঘরের লোক, শুধু কিছু মুড়ি আর বাতাসা নিয়ে আসে বলে ন্যাড়া, বেতো, গুন্নিদের অপেক্ষা থেমে থাকে ওই ঢিবির ছায়ার কাছে। এই গ্রামে মানুষ থাকে সাকুল্যে জনা চল্লিশ মত।
আসছে ভোটের মুখে নাকি গাঁয়ে বিজলি আসবে, হারুন খবর দিয়েছে বিশুখুড়োকে। বিশুখুড়ো এই গ্রামের জীবিত সার্বজনীন খুড়ো। খুড়োর বিশ্বাস হয় না হারুনের কথা। নবীন শহরে পড়তে গিয়েছিল তা প্রায় বছর তিরিশ হবে, বিন্তির কোন ভাইয়ের ছেলে নাকি খবর পাঠিয়েছিল নবীন খুব মস্ত ডাক্তার হয়েছে, দু-এক বছরের মধ্যে গাঁয়ে ফিরবে। এক, দুই করে খুড়োর সব বন্ধু বাঁশবন পেরিয়ে গ্যাছে, ছেলেকেও মনে মনে সেখানেই শুইয়ে এসেছে বিশু, বিজলীর কথায় তার কোনো হেলদোল দেখা গ্যালো না। শহর গাঁয়ের রক্ত খেয়ে নেয়। বিশু, লক্ষ্মীদের দোরের পাশ দিয়ে ভিজতে ভিজতে আসছিল, এমন সময় খগেনের মা কে দেখে বুড়ো মনে মনে শিউরে উঠলো, নাম ধরে ডাকার আগেই লক্ষ্মীর বাপ উঁচু গলায় বললো, “খুড়া, ভিজছ ক্যানে ?...” কথা শেষ করতে না দিয়ে বিশু বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে ডান হাতের লাঠি উঁচিয়ে তাক করলো খগেনের মায়ের দিকে, অচিন্ত্য বেড়ার কাছে এসে খুড়োকে ধরে দাওয়ায় বসিয়ে ভেতর দিকে হাঁক ছাড়ল, “লখি, জল দে খুড়াকে” তারপরে নিজে মাথায় গামছা জড়িয়ে বাইরে এসে বাঁ হাতের পাতাটাকে চোখের ওপরে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে গ্যালো বুড়ির দিকে।
বৃষ্টি ধরে এসেছে কিছুটা। ঢিবির ওপর ন্যাড়া দাঁড়িয়ে দু-হাত নাড়ছে মাথার ওপর। গুন্নি আর বেতো দৌড়ে আসছে নুরদের বাড়ির পাশ দিয়ে, ছাগলগুলো ভিজে চুপসে গ্যাছে। খগেনদের ভিটের সামনে কেউ গুল রেখেছিল শুকোতে, মিশে গ্যাছে কাদার মধ্যে। লক্ষ্মীদের দাওয়ায় একটা লাঠি ঠেস দিয়ে রাখা। নুর ভিজে খড় উঠোনের কোনে গুছিয়ে রাখছে। মেহগনির ছায়া ন্যাড়ার হাতের আঙ্গুলের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। হারুনের সাইকেল বেশ দুরে একটা গর্তে লাফিয়ে উঠলো, বাঁশবনের পেছন থেকে পাঁচ জন প্রৌঢ় গামছা গায়ে এগিয়ে আসছে মোড়ের দিকে। আমরা অনেক দূর থেকে ক্যামেরা তাক করে বসে আছি এই প্রাক্‌-সন্ধ্যে জুড়ে, কিন্তু ফ্রেমে কুলিয়ে উঠছে না সাইকেল থেকে খড়, আঙ্গুল থেকে বৃদ্ধ ... কিছুই!
 



আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments