আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview | তিস্তা পারের কইন্যা




 তিস্তা পারের কইন্যা | তিস্তা, সৌম্যজিৎ, শান্তনু & মৃগাঙ্কশেখর


[tista at shoot]

আড্ডা শুরু হয়নি তখনো,
তিস্তা - ‘তোমরা এডিট করছ না তো?’

সৌম্য - না।
তিস্তা -বেশ। এটাও আসলে ব্যথার একটা বড় অংশ আমি ব্যক্তিগত ভাবে এগুলো একদম পছন্দ করিনা। অমিতাভ দাশগুপ্ত যেমনটি বলতেন যে আমি কবি হলেও খিস্তি দিই। তো আমি যখন কাউকে খিস্তি দিই, সেই খিস্তিটাই আমার নিজস্বতা। সেটাকে কোথাও এডিট করার কারোর অধিকার নেই। না, আমি যদি স্যারের মতো খিস্তি নাও করি সেখানেও কতো বাধা! আমি যখন একটি পত্রিকাটায় লিখতে গেলাম, আমাকে বিষয়টা বলে দেওয়া হয়েছিল ‘নারী স্বাধীনতা’- আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে ও অভিজ্ঞতায় নারীর স্বাধীনতা। তো নারীর স্বাধীনতা বলতে গিয়ে নারীর স্বাধীনতা থেকে নারীর চিন্তার যে বৈকল্য, সেই বৈকল্যগুলো আমার অনেক বেশি নজরে পরে, প্রত্যেকদিনআমি যেহেতু লেডিস কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করি, তাই সেইখানে নারীবাদের আরেকটি দিক দেখতে পাই, যেটা হয়তো একজন পুরুষের পক্ষে দেখা সম্ভব হয়না। তো সেই জায়গাটা নিয়ে লিখতে গিয়ে কিছু পলিটিক্যাল টার্নওভার এসেছে। তো তাতে সম্পাদক বলেছেন যে আমাদের মন্ত্রী তো এটার পৃষ্ঠপোষক, তো আমি এইভাবে লিখতে পারবনা কথাগুলো অনেক মার্জিত ভাবে লিখতে হবে, সহজ করে বললে বেশ তোল্লাই দিতে হবে। তো এই তোল্লাই দিতে গেলেই ব্যথা অনুভব করি আমি। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবেই পীড়ন করুক, আমাদের বলতে হবে ‘হীরকের রাজা ভগবান’আর এই হীরকের রাজা ভগবান ব্যাপারটা আমাদের মজ্জায় মজ্জায় এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আমরা বলতেই ভুলে গিয়েছি যে আমাদের একটা স্বাধীন চেতনা আছে, আমরা আমাদের মতো করে দেখতে চাই। এটা কিন্তু আমি কোন পলিটিক্যাল ‘ইজম’ নিয়ে বলছিনা। শতক আসে, শতক যায়, রাজার চরিত্র শুধু বদলায় না, রঙটা কেবল পাল্টে যায়। রাজতন্ত্র সংবাহিত ও সংক্রমিত হয় দিনের পর দিন। একটা মুদ্রার অনেকগুলো পিঠ। এপিঠ-ওপিঠ ও নয়, অনেকগুলো। যদি খাড়া করে দেখো, শিরদাঁড়া দেখতে পাবে। আর সেই শিরদাঁড়ার দুদিকে খুব যোগসাজশ আছে, যেটা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছ না।

সৌম্য - আচ্ছা, তুমি প্রথমে বলো, যে তুমি ব্যথাকে কিভাবে দেখো?
তিস্তা - দেখো, ব্যথা যে সবসময় আমাদের কষ্টই দেয়, তা নয় কিন্তু। নিজেকে বুঝতে গেলে, নিজের ক্যাপাবিলিটিকে জাজ করতে গেলে ব্যথা পাওয়াটাও খুব জরুরী একজন সচেতন মানুষের জীবনে। তো সেই জায়গা থেকে আমি কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা নিতে ভালোবাসি। যে ব্যথাগুলো আমার চারপাশে তৈরি হয়ে আছে, তৈরি হয়ে উঠছে প্রতি মুহূর্তে, সেইগুলির সাথে আমি কতটা কমফর্টেবলি কমপিট্‌ করতে পারি? ব্যথাটা কি আমাকে আরও বেশি ইন্ট্রোভার্ট করে দেবে, না এক্সট্রোভার্ট করবে, কতটা যুঝতে পারি সেই ব্যথার সাথে? সেটা বোঝাটা খুব দরকারী। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক ধরণের ব্যথা দেখতে দেখতে, পেতে পেতে বড় হয়ে উঠেছি। সেই ব্যথাগুলোরও আবার অনেকগুলো ধাপ আছে। কোনোটা খুব তীক্ষ্ণ, একেবারে সরাসরি ব্যথা, যে ব্যথাটা আমি দেখতে পাই, ব্যথার রূপটা আমার কাছে সরাসরি প্রকাশ্য। আবার কিছু কিছু ব্যথা আমি ইন্টেলেকচুয়ালি ফিল করতে পারি, সেটা খুব অ্যাবস্ট্রাক্ট - সেই ব্যথার রূপটা চৌকো, না গোল – সেটা আমি এঁকে দেখাতে পারব না, কিন্তু বোঝাতে পারব যে ইট হ্যাপেনস্‌ টু মি সেইরকম একটা জায়গা হচ্ছে সমাজ। সমাজ প্রতি মুহূর্তে তৈরিই থাকে যে তার মতন কেউ না হলে, সে যেভাবে রুল করতে চায় প্রত্যেকদিনের জীবনকে, বা সে যেটাকে সভ্যতা বলে মনে করে, সেই সোশ্যাল কনস্ট্রাকশনটা মানুষের জন্য অনেক বড় ব্যথার জায়গা। হতে পারে, অনেক মানুষের কাছেই সেই সোশ্যাল কনস্ট্রাকশনটার কোন এথিক্যাল ভ্যালু নেই, কিন্তু তাঁরা সেই কাঠামোটাকে মেনে নিতে বাধ্য হন অনেককে ব্যথা কম দিতে চাওয়ার জন্য, বা ব্যথা না দিতে চাওয়ার জন্য, ভালো রাখার জন্য। আজকে আমিও যদি আমার কাছের মানুষকে ব্যথা থেকে দূরে রাখতে চাই, তাহলে তা করার জন্য আমাকেই সেই ব্যথাটা নিতে হয়।

সৌম্য - দেখো, সমাজের যে ব্যথা দেওয়ার কথা তুমি বলছ, সেগুলো তো আসলে সমাজেরই নিজস্ব ব্যথা, বা রোগ। সেগুলো সারাতে গেলে সোশ্যাল রেভলিউশনই কি একমাত্র পথ? কি মনে হয় তোমার?
তিস্তা - এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয় যে প্রতিটি মানুষ যদি নিজেকে বদলাতে পারে, বা নিজে যদি সেই জায়গাটা কমপিট করতে পারে, আত্মসংস্করণ যদি করতে পারে, তবেই কিছু বদল আসতে পারে। একটা সমাজ মানুষেরাই তৈরি করেছে, সেই সমাজের অত্যাচারটা মানুষেরই তৈরি। সেই অত্যাচারটা সমাজ প্রজন্ম পরম্পরায় বহন করে যখন, তখন সেটা একটা নিয়ম হয়ে যায়। একমাত্র পথ সক্রিয় অংশগ্রহণ। যদি মানুষ ভাবতে শেখে যে এটা আমার কোনও দায় নয়, তবেই সম্ভব। প্রতিটি সচেতন মানুষের কিছু দায় ও দায়িত্ব দুটোই থাকে।

সৌম্য - ঠিক এইখানেই আমি জিজ্ঞেস করব যে কোন আর্ট ফর্মের গুরুত্ব কতটা?
তিস্তা - দেখো আমি কবিতা লিখি, আমি অভিনয় করি। আমি তো গুন্ডা নই। আমি তো জিমে গিয়ে মাসল্‌ তৈরি করিনি। তাই আমি অন্যায়ের প্রতিবাদটা মাসল্‌ পাওয়ার দিয়ে করতে পারব না। তাই আমার প্রতিবাদের ভাষা কলম আর অভিনয়। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় অনেকেই বলেছেন যে গুলির পাল্টা জবাব দিতে হবে গুলিতেই। এবার যে মানুষটা বন্দুক ধরতে পারেন না, যার কাছে কলমটাই বন্দুক, তিনি সেইটুকুই যদি করতে পারেন, সেটাই অনেক বড় অবদান। এখন তিনি সেটা না ই করতে পারেন, কিন্তু প্রতিরোধের চেষ্টাটুকু তো করা উচিৎ প্রতিটি কলমধারীর। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় আমরা সহনাগরিকদের মুক্তমঞ্চ করেছিলাম, সেখানে এর উপরেই জোর দেওয়া হয়েছিল যে একজন সৈনিক যেভাবে লড়াই করতে পারেন, একজন কবিও ঠিক সেইভাবেই লড়াই করতে পারেন, শুধু লড়াইয়ের ভঙ্গিমাটা ভিন্ন।

সৌম্য - নন্দীগ্রামের কথা যখন উঠল, তখন সেই প্রসঙ্গেই আসি। তুমি প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে। যতদূর মনে পড়ছে, ঠিক তার আগের বছরই তোমাকে সি.পি.আই.এম–এর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক প্রচারের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। তুমি সেই অফার প্রত্যখ্যান করেছিলে।
তিস্তা- না, যে কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই আমি এটাই করতাম, বা করবআই অ্যাম পলিটিক্যাল বাট কালারলেস। প্রত্যেক মানুষেরই সেলফ আইডেন্টিটি, সেক্সচুয়াল আইডেন্টিটি সবকিছুর মধ্যেই একটা পলিটিক্স থাকে। সেই পলিটিক্স কিন্তু কোন দলীয় পলিটিক্স নয়।

সৌম্য - একটা ওয়ার্ল্ড ভিউ তো আছেই। না, আমি যেটা বলছি, একটি ইংরেজী দৈনিকের কথা, সেখানে তোমার একটা কমেন্ট বেরিয়েছিল যে ‘আই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স, আই উইল কাস্ট মাই ভোট অ্যান্ড দ্যাটস্‌ মাই ডিউটি।’ সেইখানে কোনোরকম ড্যুয়াল মিনিং আছে?
তিস্তা - না আমি বলছি পার্টি পলিটিক্সের কথা। এবং ক্রুয়েলটি অব দ্য পলিটিক্সের কথা। আমি একজন অ্যানিম্যাল লাভার হয়ে বলছি, যে একটি কুকুর যদি রাস্তায় দুর্ঘটনা হয়ে পরে থাকে, আমি দেখব না যে কুকুরের জাত কি? বা হু ইস দ্য ওউনার? ওউনার কি লাল-সবুজ রঙ? ভালোবাসার কালার টা তো পলিটিক্যাল নয়। পার্টি পলিটিক্সের কালার দিয়ে ভালোবাসার মেসারমেন্ট হয় না।

সৌম্য - কিন্তু, ভালোবাসা ইস পলিটিক্যাল।
তিস্তা - হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ভালোবাসা পলিটিক্যাল। আমি অ্যাপলিটিক্যাল একেবারেই বলছিনা। ভীষণ পলিটিক্যাল। ভালোবাসা, যৌন চেতনা, জেন্ডার ভীষণভাবেই এগুলো পলিটিক্যাল। এবং পলিটিক্যালি ডমিন্যান্ট এগুলো। সোশ্যিও-ইকনমিক পলিটিক্স ভীষণ ভাবে মানুষের যৌনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি মোটা দাগের যে ব্যাপারটা দেখতে পাই খালি চোখে, সেইটুকুই তো নয়। মোটা দাগের ভিতরের অনেকটা প্রসারিত অংশ আছে, সেটাও তো দেখতে হবে। হিস্টিরিয়ার পেশেন্টদেরকে দিয়ে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরো তুমি দেখতে পাচ্ছ যে একজনের প্যারালিটিক সিন্ড্রোম হচ্ছে, তার হাতটা বেঁকে গেছে এবং তিনি হাত দিয়ে কাজ করতে পারেন না। তুমি জানছ যে তার পক্ষাঘাত হয়েছে, তাই জন্য তার এটা হচ্ছে। কিন্তু দিজ অল আর রিলেটেড টু দ্য সাইকোলজিক্যাল কনটেক্সটযদি প্রপারলি সাইকো-অ্যানালিসিস হয়, তাহলে দেখা যাবে যে এইটার পিছনে এতো মানসিক কারণ রয়েছে, সেটা মানসিক অবসাদ হতে পারে, জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা হতে পারে, সেইগুলো থেকে ওইটা ফর্ম করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিস্টিরিয়ার পেশেন্টদের ক্ষেত্রে পক্ষাঘাতের ঘটনা মোটেও ফিজিক্যাল নয়, অলমোস্ট সাইকোলজিক্যাল। এবং সেইগুলিকে রিসলভ করলে তার ফিজিক্যাল এক্সপ্রেশনগুলোও বদলে যায়।

সৌম্য - তোমার এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হয় যে, জেন্ডার মুভমেন্ট বিশ্বের অন্যান্য ‘ডেভেলপড’ রাষ্ট্রে যে পর্যন্ত এখনো বিস্তৃত হয়েছে, ভারতবর্ষে সেই মাপে কি এখনো পৌঁছতে পেরেছি আমরা?
তিস্তা - ভারতবর্ষের কটা মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটুকু আছে যে সে জেন্ডার মুভমেন্ট নিয়ে ভাববে? প্রচুর মানুষ এখনো খেতেই পান না। তাঁদেরকে কুকুরেরও অধম হিসেবে দেখা হয়। এখন জেন্ডার মুভমেন্ট নিয়ে তো একটা মানুষের ফিজিক্যাল এগসিসট্যান্সই নেই, সেটাই ভীষণ নড়বড়েআজকে আমরা সিসিডি’তে বসে এরকম ভারী ভারী কথা আলোচনা করছি, আর একটা মানুষ বারো টাকা কেজির চালটা ও পায়না। তো সেই মানুষ গুলো আগে কি জেন্ডার নিয়ে ভাববে না খাবারটা নিয়ে ভাববে? এখন আবার সেটাও সত্যি যে যাদের জেন্ডার নিয়ে সেরকম ড্যুয়ালিটি নেই, তাঁদের সন্তুষ্টি যে হোয়াট অ্যাম আই? মেল, ফিমেল ইত্যাদি। কিন্তু যে মানুষগুলো সেই সন্তুষ্টির জায়গায় পৌছায়ই না, ধরো শরীর আর মনের একটা ভয়ংকর দূরত্ব রয়েছে, তাঁদের কাছে খেতে পাওয়ার চাইতেও সেটা অনেক বড় সমস্যা। যে মানুষটা ফুটপাথে থাকে, তাঁকে কেউ চুল টেনে বলে না, তুই ছেলে না মেয়ে? কিন্তু যার ঐ দূরত্বটা আছে, সে খেতে পাক ছাই না পাক, হ্যারাসড্‌ তাঁকে হতেই হবে। এটা বাঁধাধরা।

সৌম্য - এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের প্রাইম অ্যান্ড ফোরমোস্ট দায়িত্ব কি বলে তোমার মনে হয়?
তিস্তা- তুমি কোন সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের কথা বলছ? যারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন তিন মাস অন্তর?

সৌম্য- না না, জেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট। যারা ময়দানে নেমে কাজ করেন, মানুষের সঙ্গে মেশেন, ব্যথাটুকু শেয়ার করার একটা কাঁধ এগিয়ে দেন, এবং প্রপার চ্যানেলের মাধ্যমে সেইগুলি সারানোর চেষ্টাটুকু অন্তত করেন। সেই রকম। আমি অনেক অ্যাক্টিভিস্ট দেখেছি যারা কোন একটি সংস্থার উদ্যোগে কোথাও গেলেন, কথা বললেন মানুষের সঙ্গে, পরের দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তা নিয়ে ঘন্টাখানেক বক্তৃতা দিলেন, ঠিক তার পরেরদিনই সেই ব্যথাগুলো বেমালুম ভুলে গেলেন। এরকম অ্যাক্টিভিস্টে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আমাদের শহর। ব্যক্তিগতভাবে আমি এদের সঙ্গে কথা বলেছি, অনেকের অনেক রকম লোকনীতির আবছায়া দেখেছি। ব্যথা পেয়েছি। আমি এদের কথা বলছিনা।
তিস্তা- দেখো, এটা হবেই। এই শ্রেণীর মানুষ আছেন তো আমাদের সমাজেই। যে জিনিসটা যতটা কমার্শিয়ালাইজড, সেখানে তত ভিড়। আমার বেশ অবাক লেগেছে, আশা করি তুমি বুঝতে পারছ, আমি কার কথা বলছি, একজন বাউল, তিনি নিজেকে বলেন আমি কর্পোরেট বাউল। সেটাও তো কমার্শিয়াল কেতা।

সৌম্য - মানুষের কি লোভ বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন?
তিস্তা - না, আমার ধারণা, লোভ বাড়ছে না। বরং অনেকদিনের চাপা দেওয়া যে লোভগুলো ছিল মানুষের, সেইগুলো কে যে যেভাবে পারছে, এক্সপ্রেস করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ট্রান্সজেন্ডারদের পক্ষে ভার্ডিক্টটা দেননি, ততক্ষণ পর্যন্ত জনসংখ্যার পরিসংখ্যানে আমরা হাজারের মধ্যে দু-তিনজনকে পেয়েছি। কিন্তু পনেরোই এপ্রিলের পর, ট্রান্সজেন্ডাররাও মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু পাবেন সমাজ থেকে, সরকার থেকে- তখন সেই সংখ্যাটা কোন জায়গায় পৌঁছে গেছে তা আমরা দেখেছি। সুতরাং, এই যে সময়ের জন্য এই ব্যথাটা লুকিয়ে রাখা, এটাও আরেকটা ব্যথাব্যথার কথা বলতে গেলে একজন বিখ্যাত মানুষের কথা মনে হয় বারবার করে। এডগার অ্যালান পো। বিশ্ববন্দিত মানুষ ও সাহিত্যিক। আমরা যখন জেন্ডার নিয়ে রিসার্চ করছি, তখন আমরা ওর লেখার সান্নিধ্য পেয়েছি। ব্রিটেনে তখন জেন্ডার নিয়ে ভীষণ কড়াকড়ি। তাঁরা জেন্ডারের নরম্যাটিভটা কে এতটাই সাপোর্ট করেন যে এটার ভ্যারিয়ান্টটা কে কিছুতেই ওরা মানতেন না। ইট ওয়াজ অ্যা পানিশেবেল অফেন্স। উনি সুইসাইড নোট লিখছেন কবিতায়। ‘অ্যালোন’ কবিতায় লিখছেন- প্রত্যেকদিন আমি যা নই, তাই হয়ে বেঁচে থাকতে রাষ্ট্র আমাকে বাধ্য করেছে। আমার তখন মনে হয়েছে যে এই জীবনটা আমি কোনদিনও চাইনি। তাই আমি মৃত্যুর অধিকার বেছে নিচ্ছি। কতো মানুষ, ভাবো একবার- এই সোশ্যাল সিস্টেমটার জন্য তাঁদের নিজস্বতাটুকু প্রকাশই করতে পারলেন না কোনদিনও। কি অদ্ভুত দেখো, একটি মানুষের সৃষ্টি কতো মানুষ পড়লেন, পড়েই গেলেন, অথচ সমসাময়িক মানুষজন তাঁর ব্যথাটুকু নিতে পারেন নি। ব্যথাটারও কোন স্বীকৃতি নেই। এবং তিনি নিজেও সেই ব্যথাটার সামনে দাঁড়াতে পারেননি। সোশ্যাইটি এমন বড় একটা জুজু।

সৌম্য - আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে। দেখো, কদিন আগেই দীপিকা পাদুকোনের ‘মাই চয়েস’ ভিডিওটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হল। ঠিক আছে, একটা ক্যাপিটালিস্ট মনোভাবাপন্ন এন্টারপ্রেনিওর যেভাবে চিরকাল ভাবে, এটাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মাই চয়েসের ভাবনা ভাবার স্বাচ্ছন্দ্য সমাজের যে সেকশনটার এখনো আছে, সেই অংশটা যখন একাধারে বলছে – আমি কি, আমার আইডেন্টিটিটা ঠিক কিভাবে তৈরি হবে, রাষ্ট্র সেখানে ঠিক করে দেওয়ার কেউ নয়আমি এটা সিদ্ধান্ত নেব যে আমি কি। আবার অন্য হাতে দেখো, সেই আইডেন্টিটিটাকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃত করিয়ে নেওয়ার জন্যও সে লড়াই করছে কিন্তু। কোথাও কি গিয়ে মনে হয়না যে এটা এক ধরণের ডাবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড?
তিস্তা - হ্যাঁ, আমার বলতে কোন দ্বিধা নেই। একেবারেই তাই। এটাও ব্যথার আরেকটা দিক। যখন এল.জি.বি.টি মুভমেন্টটা শুরু হয়েছিল, সেই সময় অনেক পুরভাগে ছিলেনআবার যারা আসেননি, যারা স্বীকারই করেননি, ধরো স্বীকার করার তো অনেক পদ্ধতি আছে। তুমি তোমার কাছের বন্ধুর কাছে যেভাবে স্বীকার করতে পারো, সেভাবে তুমি রাষ্ট্রের কাছে স্বীকার নাই করতে পারো, কিন্তু যে মানুষটিকে বলে তুমি হালকা বোধ করতে পারো, সেই মানুষটির কাছেও সে স্বীকার করলেন না, ধরে নেওয়া গেল যে সে তবে সৎভাবে সত্যি কথাই বলছেন, যে আমি সেই ক্যাটেগরিতে বিলং করি না। কিন্তু যখন দেখা যায় যে পার্টিকুল্যার কোনও একটা সুবিধার কোন একটি শ্রেণীর জন্য বন্টিত হল, তখন সে সেই সুবিধের ভাগীদার হওয়ার জন্য এগিয়ে এসে রাষ্ট্রকে জানান দিচ্ছে, যে না আমি তো আসলে ওটাই, আগে বলতে পারিনি। এই ড্যুয়ালিটিটা আছে। জানো, কারও কারও কাছে এটা একটা ইভেন্ট। যে এই ইভেন্টটা হয়ে গেলে ঠিক আছে, আমি আমার ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দেব। এটা শুধু ভারতবর্ষ বলে নয় কিন্তু, আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও এই ড্যুয়ালিটিটা চিরকালই আছে।

সৌম্য - তুমি সেক্স আর জেন্ডারকে কিভাবে দেখ? সেক্স vis-à-vis জেন্ডার?
তিস্তা - সেক্স ইজ হোয়াট ইউ গট বাই বার্থ। জেন্ডার ইন্টারপ্রিতএড বাই সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাসপেক্টস, ডিপেন্ডিং অন ইউর সেকসুয়াল ক্যারেক্টর। একটা সেক্সের যা যা এক্সপেকটেড বিহেবিয়র যা সোস্যাইটি এক্সপেক্ট করে, সেগুলো সব হচ্ছে দ্য ইক্যুয়েশন অব জেন্ডার। এবার যখন আমরা বলছি, ট্রান্সজেন্ডার, মানে দ্য পারসন ক্রসিং দ্যাট্‌ বেরিয়ার। আজকে ধরো আমি বলছি, এই যে শান্তনু, ও চুলটা বেঁধেছে। ও মাঝেমাঝে এক কানে দুল পরে, তো আমাদের প্রাচীন আর আধুনিক সমাজের মাঝামাঝি যখন সমাজটা ছিল, সেই সময়ে এটা কিন্তু মেয়েলি। এটা কিন্তু পুরুষের লক্ষণ নয়। একটা ছেলে- সে ছোট ছোট চুল কাটবে, সে শার্ট প্যান্ট পড়বে। এবং তার কোমরটা দুললে হবেনা। কোন একটা ছেলের হাত যদি নরম হয়, তাহলে বলা হবে – ওর হাতটা কি মেয়েলি না? নরম শব্দটার ফেমিনাইজেশন হয়ে যাচ্ছে। এখনও আমরা এর থেকে বেরোতে পারিনি। তুমি ওয়াইল্ড স্টোন নামের একটি কোম্পানি। যারা বিজ্ঞাপনটি দেয় ট্যালকম পাউডারের, যে সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখতে আপনি ফেমিনিন পাউডারটিকে বর্জন করুন, পুরুষরা। এই পাউডার পুরুষ জাতির স্বার্থে। অর্থাৎ কি মেসেজ যাচ্ছে দেখো? যে মানুষগুলো পুরুষ শরীরে ফেমিনিন, তাঁরা সভ্যতার পরিপন্থী। বুঝতে পারছ? সভ্যতাটাও কমার্শিয়ালাইজড হয়ে গেল। তবেই এই অ্যাড্‌ তৈরি হতে পারে। সুতরাং ব্যথার শেষ নেই। এই ব্যথাটা ওদের কাছে কিন্তু নান্দনিক। এই ব্যথাটা দিতে পেরে ওরা একটা নান্দনিক আনন্দ উপভোগ করে।

সৌম্য - আচ্ছা, ব্যথা দিয়ে কতটা আনন্দ পাওয়া যায়? বা পাওয়া যায় আদৌ? মানে স্যাডিজম।
তিস্তা - হ্যাঁ, ভীষণ পাওয়া যায়। ক্লিনিক্যালিও পাওয়া যায়।
শান্তনু- হুম, নিশয়ই পাওয়া যায়।
তিস্তা- মানসিক ও শারিরিক আনন্দ দুইই পাওয়া যায়। এই স্যডিজমটা কিন্তু মানুষের মৌলিক একটা ইন্‌স্টিঙ্কটএই যে তুমি, আমি, আমরা সকলেই সিসিডিতে সুন্দর পোশাক পরে বসে সুন্দর সুন্দর কথা বলছি, কিন্তু নেকেড অ্যানালিসিস যখনই করা যাবে, দেখবে তুমিও কাউকে না কাউকে ব্যথা দিয়ে আনন্দ পেয়েছ, আমিও পেয়েছি।

সৌম্য - ব্যথা দিয়ে কখনো আনন্দ পেয়েছ?
তিস্তা- হ্যাঁ, পেয়েছি।

সৌম্য - বলা যাবে?
তিস্তা - হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলা যাবে। এটা বলতে আমার বেশ মজাই লাগছে। একটি অ্যাঙ্কর ছেলে, তার মনে হয়েছিল যে আমি খুব সিডাক্টিভ। সে যেভাবে ফ্যান্টাসাইজ করেছে আমাকে, সেটা পূরণ করার জন্য সে প্রচুর প্রয়াস করেছে। তো আমি তখন খুব বদ্ধপরিকর ছিলাম যে আমি ওকে ব্যথা দেব। সেটা সচেতন ভাবেই দিয়েছিছেলেটি আমার ঘরেও আসে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না কিছুতেই। যখন সে দেখছে যে উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না, তখন সে আর কিছুতেই থাকতে চায়না। তখন তার খুব তাড়া, দুম করে একটা টেলিফোন চলে আসল, অনেক কিছুই হল। তো যাই হোক, মনে মনে বেশ মজাই লাগছে। আমি তাঁকে ষ্টেশনে এগিয়ে দেওয়ার জন্য পথ ও হাঁটলাম। ট্রেন এলো। সে উঠল ট্রেনে। আমি বললাম, এবার চোখ বন্ধ করে হাতটা বাড়াও। সে হয়তো ভেবেছিল যে আমি তার হাত ধরে নামিয়ে নেব, তার অভীষ্ট সিদ্ধের জায়গায় তাঁকে নিয়ে যাব। আমি আমার পার্স থেকে দু’টাকার একটা কয়েন বের করে তার হাতে দিয়েছিলাম। শুধু বলেছিলাম, মা-কে গিয়ে বলবে যে, আমি আমার পরাজয় বিক্রি করে এলাম একটি মেয়ের কাছে। যেভাবে তাঁকে জয় করতে চেয়েছিলাম, আমি পারিনি। এই যে তাঁকে ব্যথা দিয়েছি, আমি যে কি আনন্দ পেয়েছি এমন ব্যথা দিতে পেরে... এবং আমার জয়টা এখানেই যে তিনি ব্যথাটা পেয়েছেন, তা না হলে তিনি সেই ঘটনার পরেও আমার সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করতেন, কিন্তু পারেননি। এই ব্যথাটা আমার কাছে নান্দনিক কিন্তু।

মৃগাঙ্ক - তুমি এর মাঝে আর সিনেমা করেছ?
তিস্তা - হ্যাঁ, ‘অচেনা বন্ধুত্ব’দ্যাখো, অচেনা বন্ধুত্ব নিয়ে আমি ঠিক খুশি নই। এখানে সেভাবে এক্সপ্লোরের জায়গা ছিল না। কমার্শিয়াল ছবি তো। যেরকম ডিরেক্টর বলবেন। বাজারের ব্যাপার আছে। একে সন্তুষ্ট রাখা, ওকে রাখা। সেন্সরে প্রচণ্ড গণ্ডগোল হয়েছিল। প্রভাত রায় খুব ফেভার করেছিলেন আমাদের। কি অদ্ভুত, মেয়েদের শরীর দেখানো যায়, ফ্রন্টাল ন্যুডিটি মেয়েদের দেখানো যায়, ছেলেদের দেখানো যাবে না।
শান্তনু - এটা কিন্তু শুধু ভারতে না, সারা বিশ্বেই এই অদ্ভুত মনোভাবটা রয়েছে। মেল ন্যুডিটি কে দেখবে? সারা বিশ্ব জুরেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কেউ দেখতে চায়নাএখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে মেয়েদেরকে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়। সেই বিশ্বে, ফ্রন্টাল ন্যুডিটি? তায় আবার ছেলেদের! 
তিস্তা - জাগৃতিদের ছবিটায় অনেক টেকনিক্যাল গণ্ডগোল আছে, তবু ওইটা করে আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। মৃগাঙ্ক, তুমিই তো বোধহয় এডিট করেছিলে, না? তুমি জানবে, কি গণ্ডগোল আছে

মৃগাঙ্ক - আমিও তখন নতুন এসেছি। কাজ শিখছি নতুন নতুন। ভুলভ্রান্তি তো থাকবেই। তবে ওদের ছবিটা খুব সৎ ছবি ছিল। আর হ্যাঁ, এটা ‘স্টার্ক’ করতে গিয়ে আমি টের পেয়েছি যে মেল ফ্রন্টাল ন্যুডিটি দেখানো যাবে না।
তিস্তা - এই প্রসঙ্গে রমা ঘোষের একটা কবিতার লাইন আমার মনে পড়ছে- ‘সোনাগাছি আছে থাক, আমাদের আপত্তি নেই। আমাদেরও একখানি রুপোগাছি থাক।’ যেখানে পুরুষদেরকে ন্যুড করে আনন্দ পাওয়া যায়। এখনো কিন্তু খুব কম মেয়েই আছে, সে বিবাহিত, অবিবাহিত যাই হোক না কেন, যে প্রপারলি অরগ্যাসমটা কে এক্সপিরিয়েন্স করেছে। মেয়েদের আবার অরগ্যাসম কি? অরগ্যাসম শুধু ছেলেদেরই যেন হয়। সায়েন্টিফিক্যালি, ইফ আ গার্ল ইস অন দ্য টপ, তাঁর সবথেকে বেশী প্লেজার পাওয়ার কথা। কিন্তু সামাজিকভাবে এখনো ছেলেরা মেয়েদের বটমে রেখেই আনন্দ পায়।
শান্তনু - এর কিন্তু একটা রাজনীতি আছে। যে বটমে থাকে, সে কিন্তু রেগুলেটেড হয়। আর যে টপে আছে, সে দড়িটা ধরে থাকবে।
তিস্তা - দুর্দান্ত পুরুষদের এখনো মেনে নিতে অস্বস্তি হয় যে সে ও সেক্সচুয়ালি ইমপোটেন্ট হতে পারেন। এটা তাঁর অক্ষমতা নয়, এটা একটা লিমিটেশন। এটা মেনে নিতেই অসুবিধা হয়। ফ্রাস্টেশন থেকে ক্রুয়েলটির দিকে যায়।

সৌম্য – তোমাদের যে এস.আর.এস কনসালটেন্সি, ওখানে সাইকোমেট্রিক টেস্টিং হয়?
তিস্তা - হ্যাঁ, হয়। ওটা কিন্তু কাউকে জাজ করার জন্য নয়। ওগুলো এটা বুঝে নেওয়া যে তাঁর চাহিদার পাশাপাশি সেই চাহিদার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সে নিজে সাইকোলজিকলি, সোশ্যালি কতটা সক্ষম! আমরা মোটেও চাইনা, যে ফ্রিডম দেখাতে গিয়ে কারুর জীবনের অনেক বড় কিছু হারিয়ে গেল। পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় বেশিরভাগ সময়তাই সেই ব্রিজটা অটুট রাখাটাও আমাদের কাজ। সেখানেও ব্যথা পাই। হয়তো শেষমেশ এসে ব্যর্থ হই। তবে এগুলো থাকবে, এই ব্যথাটা নিয়েই তারা চলেন। তথ্য বলছে, দশটা পরিবারের মধ্যে মাত্র দুটো পরিবারের এই ব্রিজ আমরা তৈরি করতে পেরেছি। বাকি আটটায় ব্যর্থ।

মৃগাঙ্ক - আজও অনেকেই সমপ্রেম আর সমকাম-কে অসুখ বলে মনে করে। কেন? তোমার কি ধারণা?
তিস্তা - এটা আমাদের ব্যর্থতা। ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেও কিন্তু এটা যথেষ্ট এস্ট্যাব্লিশড একটা ঘটনা।
শান্তনু – হ্যাঁ, প্রবলভাবে আছে। রামচন্দ্র যখন বনবাসে যাচ্ছেন, তখন অনেকটা দূর চলে যাওয়ার পর যখন নগরবাসীদের ফিরে যেতে আদেশ দিলেন, তখনও কিছু লোক রইলেন। তখন রামচন্দ্র বললেন, ‘আমি সমস্ত নারী-পুরুষকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিচ্ছি।’ কিছু মানুষ বললেন- ‘আমরা নারীও না, পুরুষও না’ তখন রামচন্দ্র বলেছিলেন যে ‘তোমরা যদি চাও, আমার সঙ্গে যেতে পারো’তারপর পথের ধারে তাদের ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন।
তিস্তা - না এটা কিন্তু এক ধরণের আলাদা করে দেওয়া হল।
শান্তনু - না না, দে ওয়ার ফিলিং ভেরি ইনসিকিওরডতিনি বলেছিলেন যে ‘যদি চাও, আমার সঙ্গে যেতে পারো।’ তারপর ধরো, আম্রপালী। বোল্ড ক্যারেক্টর রীতিমতোরাজনর্তকী এবং ভারতবর্ষের একমাত্র নারী যিনি চৌষট্টি কলার অধিকারিণী ছিলেন। তৎকালীন ভারতে বারবণিতা হওয়াটা ভীষণ সম্মানের ছিল। এমন নিদর্শনও কিন্তু আছে, যে বিয়ের আগে আমার বউ প্রস্টিটিউট ছিলেন, সেটা তাঁর প্রফেশন ছিল, এখন তিনি আমার স্ত্রী, আমি তার স্বামীএই মানসিকতা কিন্তু তখন ছিল। ভারত তখন এতটাই উদার ছিল। এখন তো ছোটখাটো একটা ব্যাঙ্কক হয়ে গ্যাছে।
তিস্তা - মহম্মদ বিন তুঘলক বা ওইসময়ে রাজদরবারে একজন ট্রান্সজেন্ডারের সম্মান রানীর প্যারালাল ছিল। বৃহন্নলা কিন্তু শৌর্যের অধিকারী ছিলেন। বীরাঙ্গনা। অর্জুন যখন অজ্ঞাতবাসের সময় বৃহন্নলা হলেন, সেটা মোটেও লজ্জার ছিল না। বিরাট রাজাকে কিন্তু তিনিই বাঁচিয়েছিলেন। রাজা ইলের ঘটনাও দেখো। তিনি কিন্তু যখন ইল থেকে ইলা হয়েছিলেন, রাজা বুধা তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। এরকমটা কিন্তু কখনোই আমরা দেখিনা যে তিনি অসম্মানিত হয়েছেন সমাজে বা তাঁকে অচ্ছুৎ করে রাখা হয়েছে। এখানেই ভারতীয় সংস্কৃতির উদারতা। কিন্তু একটা মিসিং লিংক যেটা নিয়ে এখনো কাজ চলছে যে ঠিক কোন কারণে মাঝের এই সময়টায় জেন্ডার কনস্ট্রাকশনটা এতো বায়াসড্‌ হয়ে গেল সমাজে।

মৃগাঙ্ক - আমি (কোনও) একজনের সাথে কথা বলছিলাম এই ব্যাপারে। উনি এই সাবজেক্টগুলো নিয়ে কাজ করেন। তিনি আমাকে যেটা বলেছিলেন যে মুসলিম শাসন যখন করে, ওদের কাছে এটা স্ট্রিক্টলি প্রহিবিটেড ছিল। সমাজের নিষ্ঠুরতার শুরু অনেকটা সেখান থেকেই হয় কিন্তু। শাসনটা বদল হয়ে গেল, কিন্তু নিপীড়নের কালচারটা বদল হলনা আর।
শান্তনু - ইট ইজ ভেরি ট্রু। পুরো ভারতবর্ষকে যদি দুটো ভাগে ভাগ করা যায়, তবে সাউথ ইন্ডিয়া অনেক বেশী এগিয়ে। সাউথ ইন্ডিয়াতে মহিলারা এখনো অনেক বেশী সম্মান পান, উত্তরের তুলনায়। সেক্স-রেশিও ঠিকঠাক, তাই ধর্ষণ হয়না। অথচ সবচেয়ে বেশী পর্ণ ফিল্ম বেরোয় ওখানেই। দ্যাট্‌স ডিফারেন্ট ইস্যু। কিন্তু মহিলা-পুরুষ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান সম্মান দেওয়া হয় মানুষকে। আমি আরেকটা কথা বিশ্বাস করি, সুন্দরী মেয়েরা ব্রেনলেস বিউটি হয়। একটা সময় পৃথিবীতে নারীরাই শাসন করত। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল। এখনো আদিবাসী সমাজে সেটা আছে।

সৌম্য - নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়াতেই আছে।
শান্তনু - কিন্তু মহিলাদের এই সাবমিসিভ করে রাখতে রাখতে, অত্যাচার করতে করতে এক শ্রেণীর নারীরা বুঝতে পেরেছেন যে ঘরের বাইরে না বেরিয়ে, কষ্ট না করেও খেয়েপড়ে বেঁচে থাকা যায়। সেই সিকিওরিটিটা তারা এখনো ছাড়তে পারেননি।
তিস্তা - এখন হয়তো ঐভাবে নেই। তবে সেই লিগ্যাসিটা আছে। আলাদা ফর্মে। যারা সেলফ্‌ প্রোক্লেইমড ফেমিনিস্ট, তাদের মধ্যেও এই ধরণের ব্যাপার দেখেছি আমি এটা আরেকটা ব্যথার দিক। লিঙ্গপরিচয়ে মহিলা, আমার প্রিয় এক কবি কবিতায় নারী স্বাধীনতার কথা বলেন, কবিতায় লেখেন – ‘আছো যত নারী সাহসিনী জাগো।’ সেই মহিলা তাঁর পুরুষ সঙ্গীটির কিনে দেওয়া হেয়ার ড্রায়ার ছাড়া চুল শুকোতে পারেন না, সঙ্গীটির গাড়ি ছাড়া কবিতা পাঠ করতে যেতে পারেন না, আর গাড়ি আসতে দেরি করলে সঙ্গীর উপর যাচ্ছেতাই খারাপ ব্যবহার করেন। কোথাও একটা ডিপেন্ডেন্সি তাহলে রয়েইছে। আবার ফেমিনিস্ট, (উম্যানিস্ট নন কিন্তু) একজন তাঁর কাজের মেয়েটি কাজ কামাই করে পড়তে গেলে কিভাবে তুলোধোনা করেন, সেটাও দেখেছি। কিন্তু নিজে সেমিনারে গিয়ে নারী স্বাধীনতা নিয়ে বক্তব্য রাখছেন। সেদিক দিয়ে নবনীতা’দিই ভালো। সরাসরি বলেন, আমি ফেমিনিস্ট নই, আমি উম্যানিস্টএই সোশ্যাল কনস্ট্রাকশনটা কিন্তু ভাঙছে না। কিছু ক্ষেত্রে অল্প ভাঙলেও প্রকৃত অর্থে ভাঙছে না।
শান্তনু - ঐ যে এখন যেমন সিঁদুর ব্যাপারটা ফ্যাশন। আমার বক্তব্য যে যদি ফ্যাশনই হয়, তবে বিয়ের আগে কেন কখনো মনে হচ্ছে না যে সিঁদুরটা একটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট!

সৌম্য - আজকে অফিস থেকে বেরোনোর আগেই ইন্টারনেটে নিউজ পড়ছিলাম, এবং দেখলাম যে সুপ্রিম কোর্ট জাজমেন্ট দিয়েছে যে একজন লিভ ইনে থাকা মহিলাও স্ত্রী-র সম্মান পাবে, এবং এর পিছনের কারণ টা কি? না, প্রপার্টি ইনহেরিট করতে পারবে। দেখো, দেখতে কতো ভালো লাগছে যে নারীদের অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা কতো যত্নশীল! কিন্তু আবার দেখো, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা একটা বেঞ্চমার্ক কি ধরছে? – বিবাহ। লিভ ইন-টা লিভ ইন, এটা বলতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। লিভ ইন-টাকে যেন তেন প্রকারেণ ‘বৈধ্যতা’ দেওয়া হবে বিবাহের ইকুয়িভ্যালেন্ট হিসেবে। এই রকম জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি আমরা।
শান্তনু - অথচ এই সেই ভারতবর্ষ, যেখানে দুশ্মন্ত-শকুন্তলা গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেছিলেন। সেইখানে আজও উত্তর ভারতে মাথায় পাথর দিয়ে মেরে মেরে রক্ত জমিয়ে ন্যাচারাল সিঁদুরের (অপ)সংস্কৃতি চলছে। অতএব, একজন অপর্ণা সেনের একটা ‘সতী’ ছবিও যথেষ্ট নয় এই বিবাহের বেড়াজাল ভাঙতে। যে ভারতবর্ষে একসময় স্বয়ম্বর সভা হতো, সেখানে এখন কালচার হয় একটা শব্দবন্ধ- ছেলেরা বিয়ে করে, মেয়েদের বিয়ে হয়।

সৌম্য - ধর্ম কি তোমার কাছে?
তিস্তা - ধর্ম খুব ব্যথা দেয় যখন আমার ঘরের পাশের নার্সিংহোমে পেশেন্টরা ঘুমোতে পারছেন না পাড়া জুড়ে মাইকে চলা কীর্তনের জ্বালায়এটাও একটা ব্যথা।
শান্তনু - না দেখো ধর্ম কিন্তু সবসময় পেইনফুল নয়। ধর্মকে আমরা খারাপ করেছি। মুসলিম ধর্ম এসেছে মিডল ইস্ট থেকে। হজরত মহম্মদের বোরখা পড়ার পিছনের যুক্তিটা আজ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান অপযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেলে তো ধর্মটা খারাপ হয়ে যেতে পারেনা। আজ রোজা রাখা ব্যাপারটাও তাই চরম ভাবে অ্যাবিউসড হচ্ছে। ইন ফ্যাক্ট, ধর্ম তো একটা ফিলসফি। বাপ্টিজিম বা সুন্নত করানোর দরকার নেই তাইধর্ম তো এটাই শেখায়, বাঁচো এবং বাঁচতে দাও। এছাড়া তো আর কিছু থাকতে পারেনা। ধর্ম কিন্তু সায়েন্টিফিক। মানুষকে ভুল বোঝাতে বালিশে বোসো না, পাছায় ফোঁড়া হবে বলা হয়। মাস্‌ ইজ নট লিটারেটতাই কালচারাল নর্মগুলো কে ফিলসফির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড হওয়াটা জানান দেয় যে আমি বেঁচে আছি প্রচণ্ডভাবে, যে জানান দেওয়াটা ছেলেদের নেই। অথচ দেখো, সেই স্বাভাবিকত্বকে কিভাবে নষ্ট করছে এই অধর্মের আচারগুলো!
তিস্তা - এই প্রসঙ্গে কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের একটা লাইন মনে পড়ছে- “ঋতুর বেলায় অশুচি নারী, অন্য সময় ঠেলবো হাঁড়ি?”     
শান্তনু - ক্ষমতার লোভ কেউ এড়াতে পারেনা, সে পুরুষই হোক আর নারী!

সৌম্য - চার্লস চ্যাপলিনের একটা কথা আছে: “You need power, only when you want to do something harmful otherwise love is enough to get everything done.”

আচ্ছা, এবার একটু অন্য কথায় আসি। তিস্তা, তুমি কবিতা পড়ো, নিজে কবিতা লেখোও। কিছুদিন আগে তোমাকে আমরা ক্যালকাটা লিটারারি মিটে দেখেছি। আমি সেই কথা জানতে চাই তোমার মুখ থেকে, তোমার অভিজ্ঞতা কি বলে?

তিস্তা - এটা দু’ভাবে বিষয়টাকে দেখছি। প্রথম যখন রত্নাবলীদি আমাকে ফোন করলেন ‘তিস্তা তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেখানে আমি চেয়ার করব। সেটার শিরনাম হচ্ছে তাহাদের লেখা।’ ‘তাহাদের’ মানে প্রান্তিক মানুষদের লেখা। কারা প্রান্তিক মানুষ?- আমি, মনোরঞ্জন ব্যাপারীদের মতো লোকজন। তিনি চণ্ডাল সম্প্রদায়ের একজন লেখক। কিন্তু আমার একটা বড় প্রশ্ন হল প্রান্তিকতা নিয়েই যদি বলতে বলা হয়, তাহলে কেন তিস্তা বা মনোরঞ্জনবাবু। ওখানে আমি বলেওছিলাম। ওখানে আমাদের পরেই যে কবিদের সেশন ছিল, তারা তখন আসতে শুরু করেছেন। প্রান্তিকতারও অনেক ক্লাস আছে। যদি ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড্‌টাকে প্রান্তিকতা ধরে নিই, তবে সেখানেও একজন ফ্লাইটে যাতায়াত করেন, আর একজনকে ট্রলি বা ট্রেনেই যেতে হয়। কেউ কমার্শিয়ালি প্রান্তিক হন, কেউ তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকে প্রান্তিক হন। আমার যেটা মনে হয়েছে আমরা প্রান্ত থেকে কেন্দ্রকে নাড়ানোর চেষ্টা করেছি সেই অনুষ্ঠানে। কারণ আমাদের যে জায়গাটা দেওয়া হয়েছিল সেটা কিন্তু মূল মঞ্চ নয়। প্রান্তিক মানে আক্ষরিক ভাবেই প্রান্তিক একটা মঞ্চ। যেখানে যারা খুব সিলেক্টিভ লেখা লেখেন, সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে লেখেন, তাদের জন্যই ওই মঞ্চ। জেনারেল মঞ্চ সেটা কিন্তু ছিল না। আমাদের যেটা উদ্দেশ্য ছিল, ওখানে যদি কেউ না শুনতে যান, তবে আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী আমরা লোকজনকে আমাদের কথা শুনতে বাধ্য করব। তারপরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা সেখানে আসবেন। কিছু মানুষ বুঝবেই বুঝবেন। সবাই মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন নামনোরঞ্জনদা একজন রিক্সাচালক ছিলেন। কেউ চায় না তিনি লেখা লিখুন, যতই মার্ক্স আওড়ান না কেন। তিনি রিক্সা না চালিয়ে লেখা লিখতে শুরু করলে তো সমাজের উঁচু–নিচু টাই গুলিয়ে যাবে। আজ যদি দরিদ্র মানুষ না থাকতো, তাহলে সিসিডিতে বসে আমরা এই আড্ডাটা দিতে পারতাম না। আজ জেলে বসে মনোরঞ্জন’দার অক্ষরজ্ঞানটা যদি তৈরি না হতো, মহাশ্বেতা দেবীর মতো মানুষ যদি তাঁকে অনুপ্রাণিত না করতেন, তাহলে লেখক মনোরঞ্জন’দা কে তো আমরা পেতামই না। অতএব, মানুষই পারে ইচ্ছেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নের সড়কে হাঁটতে গেলে একটা হাত ধরতে হয়। আর এটা মানুষ পারেন। কিন্তু কয়জন আর করেন? বল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, আমরা যদি পাঠকের পাঠের অভ্যাসটাই না তৈরি করতে পারি, তবে সে কি করে একটা লেখা পড়ে বলবে যে লেখাটা ভালো না খারাপ? তাই আজও তাজ বেঙ্গলে কতজন পাড়ার ফুচকাওলা কে নিয়ে আর খেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তাই না? ফুচকাওলাকেও সেই কমফোর্ট জোনটা দিতে হবে যে তাজ বেঙ্গলে যাওয়ার জন্য তুমি আমার ইক্যুয়াল। কিন্তু কেউ সেটা করি নাতেমনই ক্যালকাটা লিটারেরি মিটে মানুষ গিয়ে মুড়ি চানাচুর খাবে। সে কেন প্রান্তিক মানুষের কবিতা পাঠ শুনতে যাবে? প্রথম দিকে মনোরঞ্জন’দা খুব মনমরা হয়েছিলেন যে একটাও শ্রোতা নেই। তবে হ্যাঁ, কিছু মানুষ উৎসাহ ভরে আলোচনা শুনতে শুনতে এগিয়ে এসেছেন। আর এসেছেন পরের সেশনে প্রথম শ্রেণীর কিছু কবিরা। কবিদেরও শ্রেণী বিভাজন আছে। তিস্তা মুখে রঙ মেখে রাস্তায় দাঁড়াবে, তিস্তা টাকা তুলবে, জুলুমবাজি করবে– এটা ভাবতেই অনেকে অভস্ত্য। তো সে হেন তিস্তা আবার কবিতার কি বোঝে! সেই জায়গা থেকে তিস্তা কিন্তু প্রান্তিক। তাই কমার্শিয়ালি লিটারারি মিট জমে গেল। এটাই।

শান্তনু - মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছে হয়, একদিন এসপ্ল্যানেডে নামব বাস থেকে। দেখব, ভিখিরি থেকে জাঙিয়া বিক্রেতা, হেঁটে চলা অগুনতি মানুষ সক্কলে সুন্দর মেকআপ করে, কস্টিউম পড়ে রয়েছেন। কিন্তু, সেটা হবে না। কি সুন্দর লাগে যখন এই স্বপ্নের মতো দৃশ্যটা আসে আমার মনে, মাথা বলে, এটা হবে না।

 

সৌম্য – সাহিত্যকর্মী হিসেবে তোমার কি মনে হয়, যে সিরিয়াস পাঠক কমে গেছে? সমালোচনা করার অভ্যাস কি আমাদের কমে গেছে বলে মনে হয়? একটা কবিতা বা একটা গল্প পড়ে পাঠক, ভালো লাগলো কিংবা ভালো লাগলো না এইটুকু বলেই কেটে পড়ছে। ইন্টেরেস্টিংলি, খারাপ লাগাটা তারা এক্সপ্রেস করতে পারছে না। বা চাইছেন ও না। এটা কোন দিকে যাচ্ছে সাহিত্য সমাজ?
তিস্তা -এখন পৃষ্ঠপোষকতার যুগ এসে গেছে। অ্যাডমিট ইট। মানুষ এসকেপিস্ট হয়ে যাচ্ছে তুচ্ছ স্বার্থের জন্য। সে জানে, আমি ওর অমুক লেখাটা খারাপ লাগলেও বলতে পারবো না, যদি বলি, পরের তমুক অনুষ্ঠানে আমি আর ওর কাছ থেকে ডাক পাবো না। খুব কম মানুষই আয়নার সামনে নগ্ন দাঁড়াতে সাহস রাখেন। তাই মুখোশ পড়তে হয়। কার্পেট লাগে মেঝের গর্ত ঢাকতে। লোপামুদ্রাদি গান – ‘মেঝেতে গর্ত ছিল’

মৃগাঙ্ক - তুমি আগে যেটা বলছিলে যে আমার লেখনীর যদি সেই ক্ষমতা থাকে যে আলাদা করে মুখে রঙ মেখে আমাকে পাঠক টানতে হবে না, তাহলে তো পাঠকের এমনিই আসার কথা। তাহলে কি কলম চলছেনা সাহিত্যে সেরকম ভাবে?
তিস্তা - শঙ্খ ঘোষ সকলে হন না। আবার ভালো পাঠকও সকলে হন না। তবে আমার মনে হয়, পাঠকের ব্যর্থতা এটাই, যে তারা অনেক ভালো কাজ দেখতে পাচ্ছেন না। মুখ গুঁজে হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে।

মৃগাঙ্ক - কিন্তু পাঠকের জানার জন্য তো একটা মাধ্যম দরকার। আমার ধারণা সেই মাধ্যমটাই আজকে পলিউটেড
তিস্তা - হ্যাঁ, এই পলিউশনের পিছনে এই মানসিকতার বিবর্তন অনেকাংশে দায়ী। তুমি সোশ্যাল মিডিয়া, এই লাইফস্টাইল ইগনোর করেও বাঁচতে পারছ না, আবার তাকেই গালাগাল করছ। সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেছিলেন যে আমার খুব কষ্ট হয় এটা ভাবতে যে কেউ আর পেপারব্যাক পড়বে না। সবাই ই-বুক পড়বে। অথচ ওনাকেও সেই সাহায্যটুকু নিতে হয় আজ, প্রোমোট করতে হয় লেখাকে। তাই আমার এখনো মনে হয়, আমি কবিতা ই-বুকে পড়ব না পেপারব্যাকে পড়ব, সেটা জরুরী নয়। জরুরী হল কবিতা পড়ার সৎ ইচ্ছেটুকু। আরেকটা কথা বলি, আমি যখন খুব বিখ্যাত একজন নাট্যব্যক্তিত্বের দলে কাজ করছি, তাঁর একটা আপত্তির জায়গা ছিল যে আমি যেন কোনদিন ফিল্মে কাজ না করি। কিন্তু আমি করেছি, করছি এবং করবও। আমার কাছে অভিনয়টা গুরুত্বপূর্ণ  মাধ্যমটা নয়। অভিনয়টা আমি ভালো করলে সেটা স্টেজেও করব, পর্দায়ও করব। ফিল্ম, থিয়েটার বা সোপ সবই সেই মাধ্যম মাত্রআমি ভারতনাট্যম আর ওড়িশি ফর্মের মধ্যে বেটার কোনটা, এটা কি করে জাজ করতে পারব? পারবো না তো

সৌম্য - তোমার কথার সূত্র ধরে আমি এটুকুই বলতে পারি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। আর সবাই নাসিরুদ্দিন হন নাযাই হোক, তোমার কি মনে হয়, মিডিওক্রিটি বেড়ে গ্যাছে প্রবল ভাবে? এই মুহূর্তে আমরা কোনও লিটারেরি মুভমেন্টের জায়গায় নেই। অন্তত আমার তো তাইই মনে হয়। যদি জিজ্ঞেস কর, কেন দরকার এই মুভমেন্টের, আমি এটুকু বলব শূন্য দশকের কবিতা কি বিগত দশক গুলোর থেকে লিটারেরি মানোন্নয়ন করতে পেরেছে? পারেনি। রাজনৈতিক কবিতা একটা বিশাল বড় অভ্যাস ছিল বাঙালির। সেখান থেকে আমরা কতটা দূরে সরে এসেছি। দুই, এখন আমাকে ডেডলাইন মেনটেইন করতে হচ্ছে একটা লেখা লিখতে। আমার যদি একটা লেখা পনেরো দিনে না লিখতে পারি, আমি লিখবো না। আমি পনেরো সপ্তাহ নেব ওটা লিখতে। কিন্তু ভালো কিছু লিখব। সেটা কিন্তু হচ্ছে না। যে যেমন করে পারছেন, একটা কিছু লিখে ফেলছেন, এবং ছাপিয়ে ফেলছেনকোথাও গিয়ে লেখককূল কিন্তু পরাধীন। তার জন্যই কিন্তু এই মিডিওক্রিটি বেড়ে চলেছে।
তিস্তা - ট্রু। ইটস হ্যাপেনিং। আমি গত তিনমাস আগেও একটি এন.জি.-তে কাউন্সিলর ছিলাম। আমি জাজমেন্টাল ছিলাম না। কারণ একজন কাউন্সিলরের কখনো জাজমেন্টাল হওয়া চলে নাকিন্তু সেখানেও গ্লোবাল ফান্ডিং- টার্গেট ফুলফিল না করতে পারলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। এই অবস্থায় আমরা চলে এসেছি। আমার যদি আজ দুপুরবেলা মনে হয় যে আমি চুপটি করে বসে একটু বাঁশি শুনব, সেই বাঁশির সুর পরেরদিন আমার ভাতের থালায় আছড়ে পড়বে। তাই প্রচণ্ডভাবে পরাধীন জীবন আমাদের। গঙ্গার ধারে প্রেম না করে মানুষ হোয়াটস্‌-অ্যাপ করছে। মিডিওক্রিটিটা এখানেই।

সৌম্য- লি ট্‌ ল ম্যাগাজিন কিভাবে দেখো?
তিস্তা - যেভবে তুমি লিট্‌ল শব্দটা উচ্চারণ করলে, আমার ধারণা অতটাও লিট্‌ল নয় এই প্ল্যাটফর্মটা। অনেক বেশী স্বাধীন জায়গা এটা। যেটা কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনে নেই। আমার ব্যথার জায়গা- বৈতালিক আমার হাতে তৈরি এবং কমার্শিয়াল কেতার কাছে হেরে গিয়ে বৈতালিকের মৃত্যুও আমায় চোখের সামনে দেখতে হয়েছে। ব্যথা পেয়েছি। একদল মানুষ অপরের স্বাধীনতা খর্ব করতে উদ্যত, আরেক দল মানুষ হেরে যাচ্ছে এডগার এলান পোর মতো। এটাই এখন আমাদের জীবন। তাই দিশা আত্মহত্যা করলে তোমাকে নাকে-মুখে গুঁজে দেওয়া হয় যে না না, দিশা আসলে সমপ্রেমী ছিল না, ওটা শ্যুটিং-এর চাপেই আত্মহত্যা, কিংবা একটি ছেলেকে নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে গণ্ডগোল। ভাবো একবার! আজও এই অসভ্য, বর্বর যুগে দাঁড়িয়ে মানুষ লড়াই করছে। এবং হাজার ব্যথার মধ্যে এটাই দিশা যোগায়। কেউ যদি আজ আমাকে বলে, আমি মেয়ে নই, আমার আর কিছু যায় আসেনা। একটা মেয়েকে কারোর কাছে প্রমাণ করার কিছু নেই যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে বলতে হবে, আমি মেয়ে, এই শোন শোন - আমি একটা মেয়ে।
শান্তনু - আমার যেটা বক্তব্য, যে আমি নারী পুরুষ আলাদা করে দেখব কেন? মানুষ হিসেবে ভাবতে কি খুব কষ্ট হয় আমাদের?
তিস্তা - দেখ এটা পলিটিক্যালি খুব ইনটেলিজেন্ট স্ট্যান্ডপয়েন্ট। মানুষ তো নিশ্চয়ই, কিন্তু নারীত্ব আর পুরুষত্বকে ইগনোর করা যায়না। একটা ব্যথার কথা বলছি। অবমানব পত্রিকার হয়ে একবার একটি ইন্টার্ভিউ নিতে গিয়েছি মমতা শঙ্করের কাছে। প্রশ্ন করেছিলাম যে লিঙ্গান্তরকামী, রুপান্তরকামী মানুষের এই ‘ইচ্ছে’-টাকে তিনি কি চোখে দেখেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে ‘আমার মনে হয়না এটা স্বাভাবিক। প্রাকৃতিক ব্যাপারটাকে ওভাবেই রাখা উচিৎ। এটা খোদার ওপর খোদকারী মনে হয় আমার। আমি মানুষ হিসেবেই সবাইকে দেখি এবং দেখব।’ তখন আমি ওনাকে প্রশ্ন করি, যে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে একটি মেয়ের সঙ্গে আপনি আপনার টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন, একইভাবে একটি ছেলেকে কি আপনি মানুষ হিসেবে সেখানে এলাউ করবেন তবে? উনি বলেছিলেন, ‘এসব বাজে প্রশ্ন আমাকে করবে না, আমি এর কোনও উত্তর দেব না।’ দিস ইস হোয়াই মানুষ হিসেবে দেখাটা একটা পলিতিক্যাল অ্যাক্ট। বুঝলে শান্তনু।

সৌম্য - শেষ প্রশ্ন,
তিস্তা – ‘শেষ বলে কিছু নেই।’

সৌম্য - হা হা, এটা ভালো ছিল। আজকের জন্য তবে শেষ জিজ্ঞাসা। আজ ধরো, রাস্তায় তোমার সাথে আমার দেখা হল, তোমাকে তিস্তা বলে না ডেকে আমি সুশান্ত বলে ডাকলাম। তুমি ঘুরে তাকালে। হোয়াট উইল বি ইওর রিয়্যাকশান?
তিস্তা - আমি ঘুরে তাকাই না। তাকাব না তো অনেক দুরের কথা। ঘুরে তাকাই ই না।
[মৃগাঙ্ক মৃদু হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানাল ব্যাপারটাকে]
শান্তনু – (হাসতে হাসতে) সুশান্ত আমার নাম না হয়ে আর যে কোনও লোকের নাম হতে পারে, কিন্তু আমি সুশান্ত নই।
তিস্তা - হ্যাঁ, তাইইআমি আর সুশান্ত তো এক নই। সুশান্ত আমার জন্মের পর দেওয়া নাম। একটা বাচ্চাকে তো আর জিজ্ঞেস করা হয় না যে আমরা শারীরিক ভাবে মিলিত হচ্ছি, তুই কি জন্মাবি? অতএব, আমি আমার জন্মগ্রহণে তিস্তাই। ভেবে দেখো, একটা ছেলে ডলফিন যদি মেয়েদের মতো আচরণ করে, তবে তাঁকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয় না অথচ মনুষ্য সমাজেই এটা হয়। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যথা। আর এই ব্যথা নিয়েই মানুষ দলছুট হয়ে যায়।
---
                        
 
                 
 | |


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments

  1. লিখা টা পড়ে অনেক ভালো লাগলো.....................
    আশা করি আরও অনেক এমন লেখা পাব।
    হাতে যদি সময় থাকে তাহলে আমার এই bd jobs site টা ভিজিট করবেন।

    www.bd-career.com

    ReplyDelete

Post a Comment