এটা গল্প হলেও পারত | উপেক্ষিৎ




                   অনন্তর অনন্তযাত্রা | উপেক্ষিৎ শর্ম্মা

[চিত্রণ: য়্যুবিৎজা ম্যাক্‌কম্বস, ইউ.এস.]

()
কপালের ব্যথাটা সুরু হল অনন্তর। সন্ধ্যে হলেই কপালটা নিয়ে পড়ে ও। সন্ধ্যে নয়, বরং বলা উচিত দুপুর উতরে যাবার অব্যবহিত পরে, বিকেল থেকেই আকাশের ধূসরতা ওর কপালে যেন ছায়া ফেলতে থাকে। কালো ঘনান্ধকার হতে থাকা আকাশটার মৌনতা যেন ওর শরীরটাকে ঘিরে ফেলে। নিশ্চেষ্ট ন্যাতার মত শব্দজব্দ হয়ে পড়ে অনন্ত। তিরিক্ষি মেজাজের দিনটা পেরোলেই রাত্রির বুকফাটা রোশনাই, শহর সভ্যতার সভ্যতর সংস্করণ যাকে বলে, অনুন্নত দেশটার উন্নয়নশীলতায় রূপান্তরের নিদর্শনও বলা যায়, শঙ্খধ্বনি নেই, সন্ধ্যেদীপ জ্বলে না, সন্ধ্যারতি হয় না, এখন শুধুই ‘দেখ বিশ্ব, আমি কত এগিয়ে গিয়েছি’-র বিজ্ঞাপন। আর এই সন্ধ্যে উতরানোর সন্ধিক্ষণে অনন্তর কর্মক্লান্ত শরীরটাতে অন্ধকার ছুঁয়ে থাকা ঝিমুনি আর ক্রমবর্দ্ধমান যন্ত্রণা। কপাল জুড়ে যন্ত্রণা। যন্ত্রণাটা ক্রমশ বাড়তে থাকে, বুঝতে পারে অনন্ত।
        স্বল্পখ্যাত ওষুধ কোম্পানির পয়সা দেওয়া ওষুধ ফেরিওয়ালা, মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ যাকে বলে, অনন্ত, সারাদিন চিড়ফাড় রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে, ‘ওষুধ নেবে গো’ বলতে বলতে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে বয়ে বেড়ায় শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। কেউ স্লা এসব কোম্পানির মাল রাখতেই চায় না! ওর পোড়খাওয়া ক্ষয়াটে পাকান চেহারাটা যেন ওর কোম্পানিরই প্রতীক। সারাদিনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টান্তে বিফলতা আর কপালটা নিয়ে অনন্ত এখন জীবনদায়ী মেডিকেল হলে ঢুকতে ঢুকতে আলতো চেপে ধরল চোখের পাশের রগ দুটো। একটু একটু করে জোর দিচ্ছে, আরও জোরে, আরও। বেশ আরাম লাগছে। দপ্‌ দপ্‌ করতে থাকা রগ দুটো ওর হাতের চাপের বিরুদ্ধে নিরুচ্চার প্রতিবাদ করছে। তাতে অনন্তর আরাম হচ্ছে। আরাম হচ্ছে কি আদৌ? এটাকে কি আরাম বা স্বস্তি বলা যায়? আসলে ঠিক স্বস্তি বা আরাম কোনটাই নয়, ব্যথার ওপর ব্যথা দিয়ে ব্যথা চাপা দেওয়ার একটা বিকল্প প্রয়াস বলা যেতে পারে। তবু এখন অনন্ত কপালের মধ্যিখানে হাত দুটো চেপে রেখে আস্তে আস্তে দুদিকে টেনে নিচ্ছে। একটু আরাম বোধ হচ্ছে। আদৌ হচ্ছে কি? বরং ব্যথাটা চারিয়ে যাচ্ছে এপাশ থেকে ওপাশ। এভাবেই অনন্ত প্রায় রোজই জীবনদায়ীতে এসে বিকেলের শরীরের ঘাম শুকোয়। ক্লান্ত শরীরটার মধ্যে একটা শীতল অবসন্নতা পেয়ে বসে। মাথা ঝুঁকিয়ে কোণের ছোট্ট টুলটায় বসে পড়ে ও। শরীরটার ভার যেন নিতে পারে না।
        জীবনদায়ীর দোকানী জীবনদার সঙ্গে অনন্তর একটা স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ক। এই সম্পর্কটা ওদের ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের ঊর্দ্ধে। টুলটায় বসে মাথা ঝুঁকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল অনন্ত। দোকানের খরিদ্দার সামলাচ্ছিলেন জীবনদা। এরই ফাঁকে ফাঁকে দু’চারটে ‘কি, কেমন’-এর আন্তরিক বার্তা বিনিময় চলছিল ওদের মধ্যে। হঠাৎ দোকানে ঢোকার উঁচু ধাপটা থেকে কাউন্টার অব্দি মচ্‌ মচ্‌ মচ্‌... পাঁচটা জুতোশব্দে সচকিত হল অনন্ত, যার প্রতিটি শব্দকম্পনে বিদেশি দম্ভ আর কৌলিন্যের ঔদ্ধত্য প্রকটভাবে বিদ্যমান। ছেলেটা, ফিটসাদা জামা, ছাই রঙা ট্রাউজার, আলোঠিক্‌রান চকচকে খয়েরি রঙের দামি নেকটাই, বাঁ-হাতে ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলিয়ে, ডিটেল ব্যাগটা কাউন্টারে তুলে ধপ্‌ করে রেখে জীবনদার দিকে তাচ্ছিল্যের নীচু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ওর উপস্থিতি জানান দিতে হয় না। বেআব্রু পারফিউমের ঝাঁজ আর নেকটাই এর দোলাচলেই ওকে বিশিষ্ট করে তোলে। ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলাতে গিয়ে একবার অনন্তকে দেখল। অনন্তর চামচিকে মার্কা চেহারাটা দেখল। অনন্তর পোড়খাওয়া পোশাকটা দেখল। কাউন্টারের নীচে টুলটায় রাখা অনন্তর খোসপাঁচড়াক্রান্ত ডিটেল ব্যাগটা দেখল। ভ্রু ঘৃণিত করল। হাবেভাবে চোখেমুখে অনন্তর সঙ্গে একটা আপাতশত্রু সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলল। এতে অবশ্য অনন্তর নিজেকে হেয় বা অপাংক্তেয় মনে হল না। বরং অনন্ত নিজেকে এই নবাগতের এক জাঁদরেল প্রতিপক্ষ ভেবে নিজের রুমাল বার করে, আত্মপ্রসাদ লাভের সৌভাগ্যে, মুখের ঘাম, এখন মুখে ঘাম নেই যদিও তবু, মুছতে চাইল। পকেটে হাত ঢুকিয়েই রুমালের ছোঁয়ায়, রুমালের অবস্থার কথা ভেবে, রুমালের ঘামগন্ধের ভ্যাপ্‌সানির কথা ভেবে নিজেকে নিরস্ত করল। এবার ওকে সোজাসুজি দেখল, আগা-পাশ-তলা মাপল যাকে বলে। মেপে কি একটা আনন্দ পেল যেন। ছেলেটা, বাঁ-হাতে ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলিয়ে, ব্যাগ খুলে অর্ডারবুক বার করল। পেনটা বুকপকেট থেকে টেনে আনল যেন তূণ থেকে শব্দভেদী বাণ।
        - ‘ইয়েস, মিস্টার সাহা’---- জীবনদাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার ফাঁকে আর একবার অনন্তর দিকে ঈর্ষাচক্ষে তাকাল। যেন জীবনদাকে ওর উপস্থিতির গুরুত্ব আর ব্যবসায়িক কৌলিন্য জাহির করে বলতে চাইল, ‘অর্ডারটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন। আমার কিন্তু সময় খুব কম’। একটা প্রচ্ছন্ন ধমকের আস্ফালন। জীবনদার কাছ থেকে যতটা গুরুত্ব পেতে চাইছিল ততটা না দিয়ে, ‘দাঁড়াও হে, অত তাড়া কিসের। তুমিও ত’ বিক্রেতা’---- এরকম একটা ভঙ্গিতে জীবনদার ব্যস্ত উত্তর,
        - জাস্ট এ মিনিট। এবার ছেলেটা ‘রেডী টু ফায়ার’ ভঙ্গিতে অর্ডারবুক-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে পেনটা নিয়ে কিছু লিখতে উদ্যত হল। জীবনদা নিজের ব্যস্ততা কাটিয়ে একটা নোটখাতা বার করে ওল্টাতে ওল্টাতে অর্ডার দিতে থাকল। ছেলেটা অর্ডারটা নিয়ে একটা বিলবই বার করল, কিছু লিখল। লেখা শেষ করল যেন পিকাসোর ‘পীস ডোভ’ আঁকার শেষ আঁচড়টায় টান দিল। বিলটা জীবনদার কাছে এগিয়ে দিতেই জীবনদা, ‘আগামী সপ্তাহে আসুন...’ কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ছেলেটা ইংরেজীতে কতকগুলো আধা-অসভ্য কর্কশ কটু কুবাক্য বলে জীবনদাকে নাকাল করার চেষ্টা করল। ছেলেটার নিমতেতো ঘেও ইংরেজীর প্রকাশভঙ্গী ও ব্যঞ্জনা অনন্তকে ক্রুদ্ধ করল। ভাবল, ইংরেজীটা কি এতই অভদ্র ভাষা! প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হলেও পরে চোয়াল শক্ত করে ক্রোধচাপা ভদ্রতায় বলল,
        - হ্যালো, মিস্টার, মাইণ্ড য়’র ল্যাঙ্গোয়েজ। এমন কর্তৃত্ব আর পরিস্থিতির ওপর আধিপত্য কায়েম করে অনন্ত কথাটা বলল যে জীবনদাও উজ্জীবিত হল। নিজের অসহায় ভাবটা কাটিয়ে বলল,
        - আমি কি আপনার কাছে বিনা পয়সায় মাল নিচ্ছি নাকি? আগামী সপ্তাহে এসে চেকটা নিয়ে যাবেন। এতে এত কথার কি আছে? অপমানাহত ঝাঁজে কথাগুলো বলল জীবনদা। বাঁ-হাতে ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলিয়ে ছেলেটা ওর সেই কটুগন্ধী ইংরেজীতে ফুঁসে উঠল,
        - তুমি কি ভেবেছ আমি এখানে ওষুধের হকারি করতে এসাছি? আঁতে ঘা লাগল অনন্তর। একটু ব্যঙ্গাত্মক সুরে একটু টেনে টেনে নিজস্ব পরিচ্ছন্ন ইংরেজীতে বলল,
        - তাহলে কি করতে এসেছ ভাই!
        - হু দ্য ব্লাডি হেল ’য়ু আর টু পোক ’য়োর নোস ইন বিটুইন আস? কপালের ব্যথা আর ক্রোধের উত্তাপ—এই দুই বিপরীত মেরুর টানাটানিতেও নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে অনন্ত জীবনদাকে দেখিয়ে বলল,
        - এই যে ইনি, শ্রী জীবন সাহা, ইনি আমার দাদা হন। ওঁর সঙ্গে এভাবে কথা বললে আমায় নাক ত’ একটু বড় করতেই হবে। অনন্তকে একশ’ ভাগ আমল দিয়ে, এক ভাগও আমল না দেবার ভান করে জীবনদাকে যাকে বলে থ্রেটন্‌ করার উদ্ধত ভঙ্গীতে বলল,
        - এভাবে আমরা মাল সাপ্লাই করি না। বলে বাঁ-হাতে ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সেই নাটকীয় মচমচানির অনুরণনে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। জীবনদা ‘আরে শুনুন, শুনুন...’ বলে ওকে ফেরাতে চাইল কেননা এসব বড় বড় কোম্পানির মাল না রাখলে অনেক খরিদ্দার নষ্ট হবে। সেটা অনন্তও বোঝে। তাই চারটে মচ্‌, মচ্‌ শব্দ শেষ হতেই মোড়লি চালে হেঁকে উঠল,
        - এই যে মিস্টার, শোনোদাদা ডাকছে, শুনে যাও। ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটা। মচ্‌ মচ্‌ মচ্‌ মচ্‌ চারটে, যেন মচকান পায়ের পদক্ষেপে ফিরে এসে, ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি বাঁ-হাতে সামলিয়ে, ডান হাতে ধরা ব্যাগের ভারে একটু কেদ্‌রে অনন্তর সামনে এসে দাঁড়াল। আপাতত যে সম্পর্কে ওর শত্রু। বলল,
        - বলুন, কি বলার আছে। দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি। এখন ছেলেটার মুখে ইংরেজীতে এই কথাগুলো কত সুললিত লাগল। এখন অনন্তর মনে হল, সত্যি, ইংরেজী ভাষাটা কি মিষ্টি আর বিনম্র। অনন্ত ধমকানো বা চমকানোর মেজাজে বলল,
        - আপনি জানেন, জীবনদায়ী-তে মাল না দিলে এ চত্বরের কোনো দোকান আপনাকে কোন অর্ডার দেবে না? তখন আপনার এই চক্‌চকে নেকটাইটা রাতের অন্ধকারের মত কাল্‌চে মেরে যাবে যে! উত্তরে ছেলেটা স্পষ্ট পরিচ্ছন্ন বাংলায় বলল,
        - আমি তো মাল দেব না বলছি না। অর্ডার তো নিতেই এসেছি। অর্ডার না পেলে আমারই তো ক্ষতি। বলে অনন্তর দিকে চেয়ে ওর সমর্থনের প্রত্যাশায় করুণ শুষ্ক হাসি ফোটাল ঠোঁটে। এক আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানীর চোস্ত মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভের ওপর এক ন্যাতাজোবড়া ওষুধ ফেরিওয়ালার ‘ভোকাল ওষুধ’ এত তাড়াতাড়ি ক্রিয়া করবে ভাবতে পারেনি জীবনদায়ীর জীবনদা। অনন্তর সঙ্গে অর্থপূর্ণ চোখ বদল করে, ওকে সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি বিনিময় করে, স্বমহিম আধিপত্য নিয়ে বলল,
        - আরে আমি কি আপনাকে টাকা না দিয়ে মাল দিতে বলছি? আসলে এখন আমার কাছে চেক বইটা নেই...
        - ও, ঠিক আছে, ঠিক আছে। সেটা আগে বললে তো..., দিনশেষে ছেলেটাও এখন ক্লান্ত অবসন্ন ভেতো বাঙালি। এখন ঘাড় নীচু। অর্ডারবুক, বিলবই বার করে নিজের কাজে ব্যস্ত। কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলানর দায়ভার পর্যন্ত নিতে যেন ব্যর্থ। চুলগুলো কপাল ছাড়িয়ে চোখে মুখে চুমু খাচ্ছে। এখন এসবে ও বিকারহীন, নির্লিপ্ত। আসলে ছেলাটাও সারাদিন চিড়ফাড় রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে, এখন জীবনদায়ীতে, অনন্তর মুখোমুখি, অনন্তর দিকে ‘পাখির নীড়ের মত’ চোখ তুলে গা-মাখামাখি প্রশ্ন,
        - আপনি কোথায় আছেন? পকেট থেকে কেতাদুরস্তহীন সাদামাটা কার্ডটা বাড়িয়ে দিল অনন্ত। ছেলেটা দেখতে থাকল। দেখতে থাকল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকল। একটু সমীহ দৃষ্টি নিয়ে, সমঝেবুঝে কথা বলার নমনীয়তায় বলল,
        - জি সি গ্রুপ?
        - হ্যাঁ। কেন ?
        - ওহঃ! আপনাদের এই ‘জি সি গ্রুপ’-এর কয়েকটা গাইনি প্রোডাক্ট আছে না, নর্থ ইন্ডিয়ায় এর মার্কেট দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। মীরাটে ছিলাম যখন, আমাদের ঐ সেম প্রোডাক্ট নিয়ে মার্কেটিং করতে গিয়ে একেবারে গাবজল খেয়ে গেছিলাম। এখন আমাদের কোম্পানি ঐ প্রোডাক্টটগুলো সাউথে ট্রাই করছে। ভাগ্যিস এখানে ট্রান্সফারটা পেয়ে গেছিলাম। নাহলে খুব ঝাড় খেতে হত ঐ প্রোডাক্টটগুলো নিয়ে এক সাথে অনেকগুলো কথা বলে ছেলেটা যেন মন হালকা করল। একেবারে রকবাজী ভাষা, আপন করা শত্রুকে মিত্র করা, সমীহ করা সম্ভ্রমে কথাগুলো বলে বাঁ-হাতে ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলিয়ে প্রত্যুত্তরের বা প্রতিপ্রশ্নের অথবা অনন্তর প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করার চেষ্টা করল। এরই মধ্যে কখন যেন অনন্তর ডান হাতটা কপালে খেলা করতে শুরু করেছে। অন্য চিন্তার মগ্নতা নিয়ে গুরুত্বহীন প্রকাশভঙ্গী নিয়ে অনন্ত বলল,
        - ভাবছি, এবার ঐ দিকে কোথাও চলে যাব। ঐ উত্তরে। অনন্তর এই কথাকে আরও গুরুত্বহীন হালকা ভাবে গ্রহণ করে ছেলেটা সহানুভূতির সুরে বল,
        - কপালে ব্যথা হচ্ছে বুঝি ? আচ্ছা দাঁড়ান... বলে ওর ব্যাগটা খুলে খুঁজতে খুঁজতে লিপস্টিকের মত একটা ছোট্টো স্টিক বার করে বলল, আমাদের একটা নোতুন প্রোডাক্ট বেরিয়েছে, এখনও মার্কেটিং শুরু হয়নি যদিও--‘এনি পেন, ইনস্ট্যান্ট রিলিফ’, ট্রাই করে দেখতে পারেন। অনন্তর ব্যথা প্রশমনের মানবিক আর্তি আর নিজের কোম্পনির ওষুধের চমৎকারিত্বের মহিমা প্রচারে উৎসুক ছেলেটা অনন্তর সমর্থন চাইল,
        -  লাগিয়ে দেব? জাস্ট রোল, ডোন্ট রাব। বলে অনন্তর কপালে ঘষে দিতে উদ্যত হল। অনন্ত কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে ওকে সার্বিক সহযোগিতায় উৎসাহিত করল। ছেলেটা স্টিকের ক্যাপটা খুলে অনন্তর কপালে আল্‌তো ঘষে দিল, প্রলেপ যাকে বলে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা হাল্‌কা অনুভূতি হল অনন্তর। মাথা তুলে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে অস্ফুটে “আহঃ”! উচ্চারণের মাধ্যমে জানিয়ে দিল, অনন্ত খুশি
        - আরাম লাগছে না? বলে গর্বের হাসি ফোটাল ঠোঁটে, যেন অনন্তর কোন উপকারে লাগতে পেরে ও কৃতার্থ এবং গর্বিত। এমুহূর্তে অনন্তর দিক থেকে সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আশায় মুখে চোখে ঔৎসুক্য নিয়ে, ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি বাঁ-হাতে সামলিয়ে, অনন্তর চোখে চোখ রাখল। কৃতজ্ঞতা স্বীকারের প্রতীক স্বরূপ দুবার চোখ নাচিয়ে অনন্ত বলল,
        - বাহ্‌! বেশ আরাম লাগছে ত’!
        - রেখে দিন। দরকারে ব্যবহার করতে পারবেন। আর সঙ্গে এই পেন-রিলিভার ট্যাব-এর স্ট্রিপটাও রাখুন। এখন একটা নিয়ে নিতে পারেন। পরে বেশি পেন হলে আরেকটা নিয়ে নেবেন। উৎফুল্ল মনে স্টিকটা আর ট্যাব্‌লেটের স্ট্রিপটা হস্তান্তরে উদ্যত হল ছেলেটা ঠিক কৃতজ্ঞ চিত্তে নয়, পরে প্রয়োজনে ব্যবহার করার কথা ভেবে খুশি মনে জিনিসগুলো হস্তগত করল অনন্ত।
()
            এখন রাত বাড়ছে। ব্যথাটাও বাড়ছে অনন্তর। এখন একা ঘরে, কাত হয়ে শুয়ে থাকা অনন্ত, কপালের যন্ত্রণাকাতর প্রায় ছটফট করতে থাকা অবস্থায় উঠে বসল বিছানায়। টেবিলে পড়ে থাকা ছেলেটার দেওয়া ট্যাব্‌লেটের পাতাটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আরও একটা ট্যাব্‌লেট বার করে খেয়ে নিল। কপালে বুলিয়ে নিল রোল স্টিকটা। চিৎপাত শুয়ে পড়ে ঠাণ্ডা হতে থাকা কপাল-ভ্রু-চোখ-রগ এর শীতল অনুভূতি উপভোগ করতে করতে, এখন, অনন্ত নেতিয়ে পড়ল বিছানায়। শুয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। যতক্ষণ স্বস্তি। যতক্ষণ ওষুধটা ক্রিয়া করছে। বাহ্‌! ওষুধটা ত’ বেশ। আরাম হচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে। ক্লান্ত অবষাদমাখা ঘুম। ঘুমে আচ্ছন্ন হল অনন্ত। আপাতত শান্তি।
        কিন্তু নাহ্‌ ! ঘুমচটা ব্যথাটা ওকে বেশিক্ষণ স্বস্তি দিল না। শরীরে জড়িয়ে থাকা ঘুমের আচ্ছন্নতা ছাপিয়ে ক্রমবর্দ্ধমান ব্যথার তীব্রতায় অস্থিরতা বাড়ছিল অনন্তর। হাত বাড়িয়ে রোল স্টিকটা নিয়ে আরও একবার কপাল-ভ্রু-চোখ-রগ-এ আলতো করে বুলিয়ে নিল। তৎক্ষণাৎ ঠাণ্ডা মোলায়েম অনুভূতির ঘুম ঘুম আমেজটা উপভোগ করল কিছুক্ষণ। ঘুম আসছে, ঘুম আসছে মনে হতে হতেও ঘুমটা দানা বাঁধল না। বরং ব্যথাটা যেন জাঁকিয়ে বসছে। রাত বাড়ছে। আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র। আরেকটা ওষুধ খেয়ে নিয়ে রাতটুকু সামাল দিয়ে নিতে চাইল ও। ব্যথার প্রাবল্য ওর যাবতীয় ডাক্তারী জ্ঞানগম্যির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে ওকে বাধ্য করল আরও একটা ওষুধ খেতেওষুধটা খেয়ে মাথার চুলগুলো দুহাতের আঙুল দিয়ে পেছন দিকে জোরে টেনে ধরে আরাম পেতে চাইছিল, এবার ওর ঘুম আসছে। ঘণ কৃষ্ণবর্ণ ঘুম। মাথার ব্যথাটা কেমন যেন চারিয়ে যাচ্ছে বুকে পিঠে হাতে, নিঃশ্বাস টানতে যেন দম আটকে আসছে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইছে কিন্তু ঘুম আসছে। বৃহদাকার রাত্রির মত নিস্তব্ধ ঘুম ওকে গ্রাস করছে। শরীর আচ্ছন্ন করা অবশ ঘুম। একবার চোখ খুলতে চাইল, কিন্তু চোখের সামনে নীল নীল অজস্র গোলাকার আলোকমালা বনবন করে চক্রাকারে ঘুরতে থাকল। ভয়ে কিংবা নির্ভয়ে নির্ভাবনায় তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ হয়ে এল। ‘আহঃ! কি আরাম!’ বলতে বলতে ঘুমে, নেতিয়ে, শরীর হিম করা অসাড় ঘুমে, অনন্ত, এখন প্রাণপাত করে ঘুম উপভোগ করছে। নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমে, অনন্ত, এখন নিজের বিছানায় একা, কাকপক্ষী পর্যন্ত টের পায়নি অনন্তর এই অনন্তযাত্রা। অনন্তর শেষ নিঃশ্বাসটুকুরও সঙ্গী রইল না কেউ।
()
        - কী! কি বলছিস কি!! অনন্ত!!! সুইসাইড?? বিস্ফোরণের মত ফেটে পড়া চমকে আর ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে উঠল জীবনদায়ীর জীবনদা। হতেই পারে না। ইমপসিবল্‌!!! ইটস্‌ এ মার্ডার। কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। কাল ঐ ফচ্‌কে ছোঁড়াটা খুব ফটফট করছিল, ঐ তো বেটা কি সব আনটেস্টেড স্যাম্পেল দিয়েছিল অনন্তকে। টেবিলের ওষুধের পাতাটা ওরই দেওয়া। বাবুর কোম্পানি প্রোডাক্টটা নোতুন ল্যঞ্চ করবে। শুয়োরের বাচ্চা... গিনিপিগ পেয়েছে অনন্তকে! ছেলেটার বাপবাপান্ত শুরু করল জীবনদা। হাড়মাস চটকাল যাকে বলে। কিন্তু, কিন্তু কেন অনন্ত এতগুলো ওষুধ একসঙ্গে...
()
        গিনিপিগ অনন্ত, এখন, অনন্তশয্যায়, একা। জীবনদায়ীর জীবনদা বিষন্ন, বিমূঢ়। নেকটাই ছেলেটা, বাঁ-হাতে ডান কপালে ঝুঁকে পড়া অবাধ্য চুলের বেয়াদবি সামলিয়ে, হতভম্ব সজল চোখে শহীদের সম্মানে অনন্তর পায়ের কাছে শ্রদ্ধানত, যেন এই সেই বীরপুঙ্গব, যে জীবন দিতে জানে নির্ভয়ে নির্বিরোধে, অন্যের জন্য, দশের জন্য, দশকোটি রোগগ্রস্তর জন্য যারা এই ওষুধটা ব্যবহার করতে পারত এবং...
        কিন্তু না, অনন্ত কারও জন্য নয়, নিজের জন্য, নিজের জীবনটাকে জীবন্ত রাখার জন্য, নিজেকে রোগমুক্ত করার জন্য ওষুধটা অতিরিক্ত মাত্রায় প্রয়োগ করে নিজেকে এভাবে... অনন্ত নিদ্রাকাতর চোখে ঘুমে ঢলে পড়তে পড়তে বলেছিল,
‘‘আহঃ! কি আরাম!’ জীবন দেবার জন্য নয়, যন্ত্রণাহীন একটা সুস্থ জীবন ফিরে পাবার প্রত্যাশায়...
()
        ওষুধটা আর বাজারের মুখ দেখে নি, কিন্তু এটাও প্রমাণ হয় নি যে ঐ ওষুধের প্রয়োগই অনন্তর মৃত্যুর কারণ। তাই আজও ঐ কোম্পানির শেয়ার দর ঊর্দ্ধমুখী 
                                                               
 


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments