কী-ওয়ার্ডে ব্যথা | জ্যোতির্ময়




       সুদেব কর : একটি অভিজ্ঞতা | জ্যোতির্ময় বিশ্বাস



[আলোকচিত্র: আলেকজান্দ্রা গুইজেরো, ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়]
()
ইলেভেন-টুয়েলভ্-এ আমরা কয়েকজন সুদেব স্যারের কাছে ফিজিক্স পড়তাম। সুদেব কর, এম.এস.সি, বি.এড্‌ ধূপগুড়ি বিবেকানন্দ পাড়ায় স্যারের ভাড়াবাড়ি। আমি, মন্টি, সুদীপ, চৈতন্য সপ্তাহে দু'দিন তাঁর কাছে যেতাম। খুব ভালো পড়াতেন স্যার। আমি ছিলাম হুজুগে সায়েন্স নেওয়া কবিতাপ্রেমী হালকা আঁতেল মার্কা স্যার ‘দেশ’ পত্রিকা রাখতেন, মাঝে মাঝেই পড়া শেষে চেয়ে নিয়ে পড়তাম। স্যার হাসতেন। অমায়িক ছিলেন স্যার। খালি মাঝে মাঝে ওপর দিকে ঢেঁকুর তুলতেন আর বলতেন পেটটা ভীষন ব্যথা করছে, দেখি ক'দিনের জন্য হায়দরাবাদ গিয়ে
তারপর ইলেভেন পাশ করে গেলাম কোনোমতে, তখন ২০১১’র জুলাই- এরকম হবে, এক বৃহষ্পতিবার বিকেলে পড়তে গিয়ে শুনলাম স্যার শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে ভর্তি!
বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। স্যার ফোন করলেন। আবার আমরা পড়তে গেলাম। কী হয়েছিলো জিজ্ঞেস করাতে বললেন “স্টমাকে আলসারের মতো হয়েছে, হালকা ছুলে ছুলে গেছে এই আর কিওষুধ খাচ্ছি, ঠিক হয়ে যাবো! আর বল, ইলেক্‌ট্রোম্যাগনেটিসমের যে পার্টটা...।”
টুয়েলভের পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষা ভীষণরকম যা-তা হবার কারণে নিজে স্যারকে ফোন করলাম না। অবশ্য ফোন করলেও স্যারকে পেতামনা। কারণ স্যার তখন মুম্বইয়ে চিকিৎসাধীন। স্টমাক ক্যান্সার। ক্রিটিক্যাল ফেজ্। কেমোথেরাপি চলছে। স্যারের পেটব্যথার কারণটা মুহুর্তে স্পষ্ট হলো। আমাদের কারুরই কিছুই করার ছিল না। রেজাল্ট বেরুলো, পাশও করে গেলাম। ইংরেজী অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম জলপাইগুড়ি এসি কলেজে। ধূপগুড়ির বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ির মেসবাড়িতে থাকা শুরু হল।
২০১৪ এর ৭ই মার্চ সকাল। পিঠের নীচ দিকে কোমরের কাছে বীভৎস ব্যথায় ছটফট করতে করতে ঘুম ভাঙলো আমার! অতো সকালে জলপাইগুড়ির কোথায় কোন ডাক্তার বসেন জানতাম না। খুঁজতে খুঁজতে  মুহুড়িপাড়ার দিকে একজন ডাক্তার পেয়ে গেলাম। অসহ্য যন্ত্রনায় না পারছি বসতে, না পারছি দাঁড়াতে!  ডাক্তারবাবুর নির্দেশে এক্স-রে, ইউ.এস.জি করালাম। গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়ল, তিনটে- বেশ বড়সড়। এদিকে দু'মাস পরেই পরীক্ষা। বাবা বললো চট করে অপারেশানটা করিয়ে নেওয়া ভালো। নইলে পরীক্ষার আগে আরো অসুবিধায় পড়তে পারো!
১১ই মার্চ। শিলিগুড়ির বেসরকারি নার্সিংহোমের এক্সিকিউটিভ কেবিনে আমি শায়িত। ঘুম ভাঙলো। পাশে বাবা, বড়মামা, মেসো। সুন্দরী নেপালী নার্স ঢুকলেন। ইংরেজীতে বললেন- ব্যথা হলে বলবেন, ইনজেকশন্‌ দেবো আমি মাথা নাড়লাম, ব্যথা নেই। বাড়ি থেকে মা ফোন করলো, কান্নাকন্ঠে শুধোলো ব্যথা করছে কিনা। বললাম নাহ্। বন্ধুদের মেসেজ আসছে। টুকটাক রিপ্লাই দিচ্ছি। এরকমই একটা মেসেজ এলো দিপাসের নাম্বার থেকে –“কাল সন্ধ্যায় সুদেব স্যার মারা গেছেন রে। স্যার একদম ছোট্ট হয়ে গেছিলেন স্যার..কাউকে দেখলে খালি কাঁদতেন। যাক্‌ গে তুই এখন কেমন আছিস...এখন কি ব্যথা আছে...!” আমি কোনো রিপ্লাই দিতে পারিনি।

()
সুদেব স্যার চলে গেছেন। আমিও সুস্থ হয়ে গেছি। ব্যথা নেই। তবু ইদানিং সেই মোটামোটা ফিজিক্স বইখুলো দেখলে টের পাই কোথাও একটা ব্যথা নিশ্চয়ই আছে...
বিয়াল্লিশ বছরের জীবদ্দশায় সুদেব স্যার বৃহত্তর সমাজের মনে রাখার মতো তেমন কিছুই করে যেতে পারেননি। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে রেখে গেছেন। দলছুটদের ‘ব্যথা’-র সঙ্গে আমার এই লেখার সম্পর্ক কি তা জানিনা, তবুও সুদেব স্যারের জীবনের শেষ ব্যাচের একজন অদক্ষ অপদার্থ ফিজিক্স ছাত্র হিসেবে এটা আমার তাঁর প্রতি একটিবার বিনম্র প্রণাম হিসেবে দেখতেই পারেন। এখনো ব্যথা হয়, স্যার...




আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments