পার্ট ভুলে গিয়ে | কৌস্তুভ




                          অথ চাঁদবিবি কথা | কৌস্তুভ বসু

[চিত্রণ: হানা হোশ, জার্মানি]

(গোড়ার কথা – ভারতবর্ষের ইতিহাসে চাঁদ সুলতানা একটি অন্যতম বর্ণময় চরিত্র। দক্ষিণ ভারতে আমেদনগরের রাজপ্রতিনিধি ছিলেন এই বীরাঙ্গনা। তাঁর প্রবল পরাক্রমে ধুরন্ধর মোগল সাম্রাজ্য আমেদনগরের কেল্লায় দাঁত বসাতে না পারলেও, শেষ পর্যন্ত গৃহশত্রুর ছুরিতে হার মানেন চাঁদ সুলতানাএ দেশে মোগল সাম্রাজ্য বিস্তারের পিছনে ষড়যন্ত্র ও কূটনীতির এক ঐতিহাসিক নির্মম দলিলকে আখ্যান করে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে (১৯৬৭) পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে লিখেছিলেন ‘চাঁদবিবি’। এই বহুল পরিচিত নাটকটি আজও ভীষণ ভাবেই প্রাসঙ্গিক। ‘অথ চাঁদবিবি কথা’ একটি স্বল্প-দৈর্ঘ্যের এক অঙ্কের নাটক, যার মূল অনুপ্রেরণা ‘চাঁদবিবি’। ২০১১-র বাংলা নববর্ষে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। নাটকটিতে বক্তা এক, চরিত্র একাধিক।
আগেকার দিনে মহিলারা খুব একটা যাত্রা করতেন না। সেইজন্য পুরুষেরাই স্ত্রীলোক সেজে মঞ্চে অভিনয় করতেন। এই ভাবে নারী চরিত্রে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছেন ছবিরাণী, চপলরাণী বা চপল ভাদুড়ি প্রমুখ বাংলা যাত্রার প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা। এমনই একজন বড় অভিনেতা এই গল্পের নায়ক। অসামান্য অভিনয় দক্ষতায় তিনি নিজে যেমন উপরে উঠেছেন, দলেরও হয়েছে তেমন শ্রীবৃদ্ধি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে, আজ মুহূর্তের কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল লোকটিকে ফেলে দিয়েছে এক কঠিন বাস্তবে।)

(মঞ্চসজ্জা একটা ঘর। মেঝেতে একটা টিনের বাক্স। দু’ধারে দুটো আয়না, একটা কাঠের চেয়ার। বিক্ষিপ্ত কিছু মুখোশ ইতস্তত ছড়ানো। একধারে একটা ক্যানভাস। ছেঁড়া পোস্টার ‘চাঁদবিবি’। পুতুল হাতে বসে যাত্রার নায়ক। বয়স ষাট  ছুঁই ছুঁই)

একটু আগে আল্পসের চুড়ো থেকে পা হড়কে পড়ে গেলাম।
জানি না কী হয়েছিল। কথাগুলো মাঝপথে গলার কাছে সদর দরজায় থমকে দাঁড়ালো। তালগোল পাকিয়ে গেল তোর রাগ, অভিমান, শব্দগুলো। অবশ্য তোর বলছি কেন, ওগুলো তো আজ আমারই কথা। সকলে আমাকেই যে ডাকে ‘চাঁদবিবি’।
মুহুর্তের মধ্যে ছুঁড়ে এলো রসিকতা – অনেক হয়েছে বুড়ো, এবার ঘরে বসে হাওয়া খাও।
ছক্কাবাবু বললে, ব্যাটার বড্ড দেমাক বেড়েছিল। পার্ট ভুলে আমার কত লোকসান করে দিল!
পঞ্চাবাবু বললে, নপুংসক। ব্যাটাছেলের শখ যায় না, মাগী সেজে খালি রঙ্গ!

তুই বল্ চাঁদ, তেত্রিশ বছর যাত্রা দলে কাটিয়ে এই ছিল আমার প্রাপ্য?
এখনও গড়গড় কাব্য করতে পারিঃ
চাঁদবিবি ।। ক্ষুব্ধ হয়ো না নন্দন সিং। জীবন নিতে সবাই পারে। দিতে যে পারে, সেই তো মানুষ। মরে গেলে তো ফুরিয়েই গেল। সদয় ব্যবহারে পশু বশ হয়, আর মানুষ বশ হবে না?
নন্দন সিং ।। মানুষ হলে বশ হত, কিন্তু এ কেউটে সাপ, দুধকলা খেয়ে বেশি করে বিষ ঢাললে কী করবেন আপনি?
চাঁদবিবি ।। তোমরা এতগুলো রোজা থাকতে বিষ ঝাড়তে পারবে না?

(হাসি) কোন্ রোজার কথা লিখেছো ব্রজেনবাবু? কেউটে সাপের বিষ ঝাড়া যায়, কিন্তু রসিকতার?
মাঝে মাঝে ভাবি, তেত্তিরিশটা বছর স্টেজে দাপিয়ে বেড়াবার পর আজ কেন কথাগুলো ভুলে গেলাম? কখনও তো আগে এমন হয়নি! হঠাৎ বুকে খুব কষ্ট হল, সব তালগোল পাকিয়ে গেল। কালো মাথাগুলো চিনলাম।  যতদিন ফল, ততদিন দল!
এ বোধহয় বিধাতার রসিকতা!
সকলেই ওঁৎ পেতে থাকে, কখন খুঁটে খাবে! তোর মনে আছে চাঁদ, তোকে নিয়ে মুরাদ-এর আক্রোশ?

মুরাদ বললে – চাঁদবিবি কোথায়? তাঁকে এখানেই নিয়ে এস; খানখানান আমার আপনার লোক। চাঁদবিবির উপযুক্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করতে বল।
ধরম সিং জানালো – চাঁদবিবি আসেনি।
খানখানান অবাক - তুমি বল কী ধরম সিং?
মুরাদ রাগে ফুঁসছে – ক্ষুদ্র আমেদনগর শাহাজাদার হুকুম অমান্য করলে? তুমি তাঁকে বলেছিলে যে শ্বেতহস্তী না দিলে রাজ্যটাই দিতে হবে?
ধরম – বলেছিলাম জাঁহাপনা। চাঁদবিবি বললে, আমার জীবদ্দশায় মদ্যপায়ী হীনচেতা মোগলকে আমেদনগরের চায়াও স্পর্শ করতে দেব না। তোমাদের বেগমের যদি প্রয়োজন হয় আমাদের একটা শ্বেতগর্দভ আচে, নিয়ে যেতে পার। শ্বেতহস্তী আমি দেব না, তাতে সুবেদার গোঁসা করবে, কী তাঁর বেগম ক্ষুণ্ন হবে, আমি তা গ্রাহ্য করি না।
মুরাদ মানতে পারে না, রাগে কাঁপতে থাকে একটা নারীর এত হিম্মৎ?

হিম্মৎ … হিম্মৎ … হিম্মৎ … তেত্রিশ বছর একের পর এক পালা কাঁপিয়ে গেছি, কখনও মর্জিনা, কখনও সীতা, কখনও চাঁদবিবি … লোকে আমার হিম্মৎ মানতে পারল না। সকলেই ওঁৎ পেতে থাকে, কখন খুঁটে খাবে!
চাঁদবিবি: আমাকেও ওরা মানতে পারেনি। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মত আমেদনগর আক্রমণ করেছিল। আফজলভাই  কেঁদে ফেলেছিল –
‘যুদ্ধবিরতির আশ্বাস পেয়ে আমিই সৈন্যদের পর্যায়ক্রমে নিদ্রা যেতে বলেছিলাম। যারা জেগেছিল, তাঁদের কাঁধে মাথা নেই, যারা ঘুমিয়েছিল, তাদের ঘুম আর ভাঙবে না। এ আমারই অপরাধ হুজরাইন, আপনি আমাকে গুলি করে মারুন।
চাঁদবিবি ।। ওঠ আফজলভাই, অপরাধ তোমার নয়, আমার। নারী হয়ে শক্তির অহংকারে একটা রাজ্যের শাসনভার নিয়েছিলাম। আমার কুগ্রহ আমায় বুঝতে দেয়নি যে নারীর শাসন এদেশের আমীর ওমরাহের দল মানবে না। আর দশটা পর্দানশীন মেয়ের মত আমিও যদি বোরখা পরে ঘরের কোণে অসূর্যম্পশ্যা হয়ে বসে থাকতাম, তাহলে শিশু সুলতানকে মসনদে বসিয়ে এরা নির্বিঘ্নে দেশটাকে শোষণ করতে পারত। নারী আমি, বিজাপুরের কূলবধূ আমি, আমেদনগরে আমার প্রভুত্ব করা বরদাস্ত করতে পারল না। পীর মহম্মদ আমাকে গুলি করে মারল।’

ওরা বলে আমি নপুংসক। আর দশজন পুরুষের মত স্বাভাবিক নই। আচ্ছা, মুখে রঙ মেখে মেয়ে সাজলে পাপ? আগে প্রতি পালায় স্ত্রীলোক-বেশেই তো ওরা আমার গলায় মালা পরিয়েছে। গোয়ালঘরে রাত কাটিয়ে, বাবু সভায় নিজের ভিতরের ঘুমোনো নারী সত্ত্বাকে যখন রঙিন মুখোশে, ঘুঙরুর তালে জীবন্ত করে তুলতাম, সকলে হাততালিতে মাথায় তুলে রাখত। আর আজ সেই আমিই নপুংক!
ওরা কেন বোঝে না, মুখে রুজ-স্নোপাউডার মেখে, কাজল-চোখে পরচুলোয় বেণী বেঁধে যখন খোলা মঞ্চে দাঁড়াই, তখন আমিই চাঁদবিবি। বিজাপুরের রাণী হয়েও আমেদনগরের রাজপ্রতিনিধি। দেড়শো রজনী এমনি রঙ মেখে অভিনয় করতে করতে কখন যে জন্মগত মাংসল পুরুষ সত্ত্বা নারীর মুখোশে মিশে গেছে, বুঝতেই পারিনি। আজ রঙিন দুনিয়া যখন ফ্লাডলাইটে প্রেমের গল্পে ঢেঁকুর তোলে, আমি আয়নায় আমার চাঁদের সঙ্গে গল্প করি। বুঝতেই পারিনি, কবে ওকে এত ভালোবেসে ফেলেছি!

রসিক বাবুমশায়েরা, তোমরা আমায় নিয়ে যত খুশি রসালাপ করো। ভুল করেছি, খুঁটে তো খাবেই! আমি যাত্রা দলের অভিনেতা। তোমাদের সুখ বেচাই যে আমার কাজ! কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাদের রসিকতা আমার ঘরের উঠোন পেরোয় না। বন্ধ ঘরে আমি বৃহন্নলা! সেখানে আমি আর আমার চাঁদ কথা বলি নিজেদের সঙ্গে। তোমাদের মখমল পৃথিবীর মত রঙ মেখে সেখানে কোন ভণিতা থাকে না; থাকে শুধু অন্তরের নির্লোভ উত্তাপ।

চাঁদবিবি ।। কাঁদছ কেন বেকুব? যাদের জন্য কাঁদছ, তারা হাতে সোনার শেকল আর পায়ে সোনার মল পরে চাবুক খাবার বাবু সাজতে চায়। তুমি আমি দেশের কজন?
অভিনেতা ।। আমি অতি মুখ্যু সই। লেখাপড়া বেশি দূর করিনি। তোদের মত অত ‘দেশ’ বুঝি না। বুঝি শুধু স্টেজ। বুঝি আলো। বুঝি রাখালদার সারেঙ্গীর কান্না। আর জানি, কাঠের মঞ্চে আমি চাঁদবিবি। বিজাপুরের রাণী হয়েও আমেদনগরের রাজপ্রতিনিধি। সেখানে আমি ছেলে, কী মেয়ে, তাতে সত্যি কী এসে যায়, বলতে পারিস?
পৃথিবীটা বড় অসহিষ্ণু চাঁদ, বড্ড কঠিন! রসিকও বটে!
                                           (যবনিকা পতন)
---
 


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments